পরিচিতি:
জহির রায়হান(জন্ম: ১৯ আগস্ট, ১৯৩৫ - মৃত্যু: ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২) ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ
করেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর তিনি তার পরিবারের সাথে কলকাতা হতে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তান) স্থানান্তরিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলায়
স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে দু'বার বিয়ে করেন: ১৯৬১ সালে
সুমিতা দেবীকে এবং ১৯৬৬ সালে তিনি সুচন্দাকে বিয়ে করেন, দুজনেই ছিলেন সে
সময়কার বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। জহির রায়হান দেশ স্বাধীন
হবার পর তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক
আগমুহূর্তে পাকিস্তানী আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান
ভাইয়ের সন্ধানে মীরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। মীরপুর ছিল ঢাকা
থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া
গেছে যে সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।
ছোটগল্প
সময়ের প্রয়োজনে
কিছুদিন আগে সংবাদ
সংগ্রহের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অগ্রবর্তী ঘাটিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্প কমান্ডার ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। সেই
ব্যস্ততার মুহূর্তে আমার দিকে একটা
খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন,আপনি বসুন। এই খাতাটা পড়ুন বসে বসে। আমি
কয়েকটা কাজ সেরে নিই। তারপর আপনার সঙ্গে আলাপ করব।খাতাটা হাত বাড়িয়ে নিলাম।
ধুলো,কালি আর তেলের কালচে দাগে
ময়লা হয়ে গেছে এখানে-সেখানে।
থাতাটা খুললাম। মেয়েলি ধরণের গোটা গোটা হাতে লেখা। মাঝে মাঝে একটু এলোমেলো। আমি পড়তে শুরু করলাম।
প্রথম প্রথম কাউকে মরতে
দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রুও হয়তো জন্ম নিত। এখন
অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি,হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে,তাই।
মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি।
মৃতদেহ কবরে নামাই।পরক্ষণে ভুলে যাই।
রাইফেলটা কাঁধে তুলে
নিয়ে ছোট্ট টিলাটার ওপরে এসে দাঁড়াই।সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। বাতাসে মৃদু
দুলছে।কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ।
দূরে আর একটা গ্রাম। খবর এসেছে ওখানে ঘাঁটি পেতেছে ওরা। একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল। একসঙ্গে থেকেছি। শুয়েছি।
খেয়েছি। ঘুমিয়েছি। এক টেবিলে বসে
গল্প করেছি। প্রয়োজনবোধে ঝগড়া করেছি। ভালবেসেছি।
আজ তাদের দেখলে শরীর রক্ত গরম হয়ে যায়।চোখ জ্বালা করে ওঠে। হাত নিশপিশ করে। পাগলের
মতো গুলি ছুঁড়ি। মারার জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। একজনকে মারতে পারলে উল্লাসে ফেটে পড়ি।ঘৃণায় থুতু ছিটোই মৃতদেহের
মুখে।
সামনে ধানক্ষেত। আলের
উপরে কয়েকটা গরু। একটা ছাগল। একটানা ডাকছে। এক ঝাঁক পাখি উড়ে চলে গেল দূরে গ্রামের দিকে। কী যেন নড়েচড়ে উঠল
সেখানে। সন্দেহে মুহূর্তে দৃষ্টি
স্থির হয়ে গেল।ক্যাম্প-কমান্ডারকে খবর দিলাম।
স্যার,মনে হচ্ছে ওরা এগুতে পারে।
তিনি একটা ম্যাপের ওপরে
ঝুঁকে পড়ে হিসেব কষছিলেন।মুখ তুলে তাকালেন। একজোড়া লাল চোখ। গত দু’রাত
ঘুমোন নি। অবকাশ পান নি বলে। তিনি তাকালেন।বললেন,কী দেখছ? বললাম,মনে হল একটা মুভমেন্ট। ভুল দেখেছ। আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তিনি। ওদের দু-এক দিনের মধ্যে এগুবার কথা নয়।যাও,ভালো করে দেখ।
এলাম নিজের জায়গায়।
একটানা তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে তন্দ্রা এসে যায়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। হয়তো
তাই ভুল দেখি।
কিন্তু বুড়িগঙ্গার পাশে
লঞ্চঘাটের অপরিসর বিশ্রামাগারে যে দৃশ্য দেখেছিলাম,সেটা ভুল হবার নয়। শুনেছিলাম,বহু
লোক আশ্রয় নিয়েছিল ওখানে।যখন গেলাম,দেখলাম কেউ নেই।
দেখলাম, মেঝেতে পুডিঙের মতো জমাট রক্ত। বুটের দাগ। অনেকগুলো খালি পায়ের ছাপ।ছোট পা। বড় পা। কচি
পা। কতগুলো মেয়ের চুল। দুটো হাতের আঙুল। একটা আংটি। চাক চাক রক্ত। কালো রক্ত। লাল রক্ত। মানুষের হাত। পা। পায়ের গোড়ালি। পুডিঙের মতো
রক্ত। খুলির একটা টুকরো অংশ। এক খাবলা মগজ। রক্তের ওপরে পিছলে যাওয়া পায়ের ছাপ। অনেকগুলো ছোট বড় ধারা। রক্তের
ধারা। একটা চিঠি। মানিব্যাগ।
গামছা।একপাটি চটি। কয়েকটা বিস্কুট।জমে থাকা রক্ত। একটা নাকের নোলক। একটা চিরুনি। বুটের দাগলাল হয়ে যাওয়া একটা সাদা
ফিতে। চুলের কাঁটা। দেশলাইয়ের কাঠি।
একটা মানুষ টেনে নিয়ে
যাওয়ার ছাপ। রক্তের মাঝখানে এখানে ওখানে অনেকগুলো কার্তুজ ছড়ানো। পাশের নর্দামাটা বন্ধ। রক্তের স্রোত
লাভার মতো জমে গেছে সেখানে।
দেখছিলাম। দেখে উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছিলাম সেখান থেকে। আমি একা নই। অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য মানুষ পিঁপড়ের মতো ছুটছিল।
মাথায় সুটকেস,বগলে কাপড়ের গাঁটরি। হাতে হারিকেন| কোমরে
বাচ্চা। চোখেমুখে কী এক অস্থির
আতঙ্ক। কথা নেই। মৌন সবাই।
সহসাই কে যেন বলল,ওদিকে যাবেন না। মিলিটারি। নৌকোয় করে লোকজন সব ওপারে পালাচ্ছিল। মিলিটারি ওদের
ওপরে গুলি করেছে। দু-তিনশ লোক মারা গেছে ওখানে। যাবেন না।
মনে হল পায়ের সঙ্গে যেন
কয়েক মণ পাথর বেঁধে দিয়েছে কেউ। একা নই।অসংখ্য
মানুষ।সহস্র চোখ। হতবিহ্বল মুহূর্ত।কোন দিকে যাব? পেছনে
ফিরে যাবার পথ নেই! মৃতদেহের
স্তূপের নিচে সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে এগিয়ে যাব। ভরসা পাচ্ছি নে। সেখানেও হয়তো মৃতের পাহাড় পথ অবরোধ করে
দাঁড়িয়ে আছে। কোন দিকে যাব?
পরমুহূর্তে একটা
হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটতে লাগলাম। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। কাঁচকি মাছের মতো
চারপাশে ছিটকে যাচ্ছে সবাই।
তারপর।
তারপর মনে হল একসঙ্গে
অনেকগুলো বাজ পড়ল। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। শুধু শুনছি। অনেকগুলো শব্দের
তাণ্ডব।মেশিনগানের
শব্দ।
বাচ্চার কান্না। কতগুলো
মানুষের আর্তনাদ। কাতরোক্তি। কয়েকটা কুকুরের চিত্কার। কান্না। মেশিনগানের শব্দ। মানুষের বিলাপ। একটি কিশোরের
কণ্ঠস্বর। বাজান বাজান? হারিয়ে যাওয়া বাবাকে ডাকছে সে। বাজান বাজান। তারপর শ্মশানের নীরবতা।ঘাড়ের
কাছে চিনচিনে একটা ব্যথা। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালাম। দেখলাম।না,কিছুই
দেখতে পেলাম না। সবকিছু ঝাপসা হয়ে এল। মনে হল চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। বুঝতে পারলাম জ্ঞান হারাচ্ছি। কিংবা
মারা যাচ্ছি।
সামনে ধানক্ষেত।একটা
লাউয়ের মাচা।কচি লাউ ঝুলছে। পেছনে কয়েকটা বাঁশবন।আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা
পুরোনো দালান।ওখানে আমরা থাকি।
মোট সাতাশজন মানুষ।
প্রথমে উনিশ জন ছিলাম। আটজন মারা গেল মর্টারের গুলিতে।ওদের কবরে নামিয়ে দিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরলাম,তখন আমরা এগার জন। একজন
পালিয়ে গেল সে রাতে।গেল আর এল না। আরেকজন মারা গেল হঠাত্ অসুখ করে। কী অসুখ বুঝে উঠবার আগেই
হাত-পা টান টান করে শুয়ে পড়ল সে।আর উঠল না। তার বুক পকেটে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। মায়ের কাছে লেখা।
মা।আমার জন্য তুমি একটুও
চিন্তা কোরো না মা। আমি ভালো আছি।
চিঠিটা ওর কবরে দিয়ে
দিয়েছি। থাক। ওখানেই থাক। তখন ছিলাম ন’জন।
এখন আবার বেড়ে সাতাশে
পৌঁছেছি। সাতাশ জন মানুষ। নানা বয়সের।ধর্মের।মতের। আগে কারো সঙ্গে আলাপ ছিল না। পরিচয় ছিল না। চেহারাও দেখিনি কোনদিন।
কেউ
ছাত্র ছিল। কেউ দিনমজুর। কৃষক কিংবা মধ্যবিত্ত কেরানি। পাটের দালাল। অথবা
পদ্মপারের জেলে। এখন সবাই সৈনিক। একসঙ্গে থাকি।খাই।ঘুমোই।
রাইফেলগুলো কাঁধে তুলে
নিয়ে যখন কোনো শত্রুর সন্ধানে বেরোই তখন মনে হয় পরস্পরকে বহুদিন ধরে চিনি। জানি।
অতি আপনজনের মতো অনুভব করি।
মনে হয় দীর্ঘদিনের
আত্মীয়তার এক অবিচ্ছেদ্য বাঁধনে আবদ্ধ আমরা।আমাদের অস্তিত্ব ও লক্ষ্য দুই-ই এক।মাঝে মাঝে বিশ্রামের মুহূর্তে গোল হয়ে
বসে গল্প করি আমরা।
অতীতের গল্প।। বর্তমানের
গল্প।। ভবিষ্যতের গল্প।। টুকিটাকি নানা আলোচনা ।
ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।আনতে
হবে। কদিন ধরে শুধু ডাল-ভাত চলছে। একটু মাছ আর মাংস পেলে মন্দ হত না। সাতাশ জন মানুষ আমরা। মাত্র ন’টা রাইফেল। আরে যদি অস্ত্র
পেতাম। সবার হাতে যদি একটা করে রাইফেল থাকত,তাহলে
সেদিন ওদের একজন
সৈন্যকেও পালিয়ে যেতে
দিতাম না।
মোট দু’শ জনের মতো এসেছিল ওরা। পঁয়তাল্লিশটা লাশ পেছনে ফেলে পালিয়েছে। তাড়া করেছিলাম আমরা।
খেয়াপার পর্যন্ত।গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে ফিরে চলে এসেছি।
এসে দেখি আশেপাশের গ্রাম
থেকে অসংখ্য ছেলে-বুড়ো-মেয়ে গেরস্থবাড়ির বউ ছুটে এসেছে সেখানে। কারো হাতে
ঝাঁটা। দা।কুড়োল।খুন্তি।
মৃতদেহগুলোর মুখে ঝাঁটা
মারছে ওরা। কুড়োল দিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছে ওদের হাত। পা। মাথা। বুকের পাঁজর। দা দিয়ে কুপিয়ে একটি মৃতদেহকে
শত টুকরো করতে করতে জনৈক বৃদ্ধ
চিত্কার করে কাঁদছিল। আমার পুলাডারে মারছস।বউডারে নিয়ে গেছস। মাইয়াডারে পাগল করছস। আমার সোনার সংসার পুড়ায়া
দিছস।
আল্লার গজব পড়ব ।।
আল্লার গজব পড়ব ।।
ঘৃণা।। ক্রোধ।। যন্ত্রণা।।
আমরা বাধা দিলাম। আর
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কেঁদে উঠল ওরা। করুণ বিলাপ শুরু করল। বিলাপের অবসরে নিজেদের সহস্র দুঃখ-বেদনার ইতিহাস
বর্ণনা করতে লাগল।
ছেলে নেই। স্বামী নেই।
স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে। যুবতী মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে। তিন মাস হল। হালের গরু। গোলার ধান। গায়ের অলঙ্কার। কিছু
নেই। সব লুট করেছে।
ঘৃণা।। ক্রোধ।।
যন্ত্রণা।।
এতসব বুকে নিয়ে ওরা
বাঁচবে কেমন করে? একটা বিস্ফোরণে যদি
সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যেত তাহলে
হয়তো বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে পারত ওরা।ওরা একা নয়। অনেকগুলো মানুষ। সাড়ে সাত কোটি।এক কোটি লোক ঘর বাড়ি মাটি
ছেড়ে পালিয়েছে। তিন কোটি লোক
সারাক্ষণ পালাচ্ছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে।
ভয়।। ত্রাস।। আতঙ্ক।।
জ্ঞান ফিরে এলে আমিও
পালিয়েছিলাম। পোড়ামাটির ঘ্রাণ নিতে নিতে। অনেকগুলো মৃতদেহ ডিঙিয়ে।কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেদ করে। একটা
গহনা-নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। ছেলে
বুড়ো মেয়ে বাচ্চাতে গিজগিজ করছিল সেটা।
দু’পাশের গ্রামগুলোতে আগুন জ্বলছে। কিছুক্ষণ আগে কয়েকটা প্লেন এস একটানা বোমাবর্ষণ করেছে
সেখানে। কাছেই একটা মফস্বল শহর।এখনো পুড়ছে।কালো জমাট ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে। একটা মানুষ
নেই। কুকুর নেই। জন্তু
জানোয়ার নেই। শূণ্য বাড়িগুলো প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে।সহসা অনেকগুলো মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। তাকিয়ে
দেখলাম। দূরে নদীর পারে একসঙ্গে জড়ো
হয়ে দাঁড়িয়ে কতগুলো মেয়ে চিত্কার করে নৌকাটাকে পারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ডাকছে। ওরা আশ্রয় পেতে চায় নৌকাতে।
না না, খবরদার,নৌকা ভেড়াবে না।জনৈক
বৃদ্ধ ওদের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠল।
কেন,কী হয়েছে?
কী আর হবে? বাজে মেয়ে। বাজারের মেয়ে?
বাজারের মেয়ে মানে?
মানে আবার কী সাহেব? বেশ্যা। বেশ্যা চেনেন না? ঘৃণায়
চোখমুখ কুঁচকে এল তার। তার একার নয়। অনেকের।
অনেকেই মুখ বার করে তীরে
দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্যাগুলোক দেখল। না না। নৌকা থামাবার দরকার নেই। আপদগুলো মরুক।
মরলেই ভালো।
নৌকা থামাও।
সহসা ভিড়ের ভেতর থেকে
একটা ছেলে চিত্কার করে উঠল।
মুখভরা খোঁচা খোঁচা
দাড়ি। রক্তজবার মতো লাল চোখ। শিগগির নৌকাতে তুলে নাও ওদের।
কঠিন কণ্ঠে আদেশ করল সে।
উত্তরে বুড়োটা বিরক্তি
প্রকাশ করলো। না ,নৌকা থামবে না।
সঙ্গে সঙ্গে সামনে
লাফিয়ে এসে বুড়োটার গলা চেপে ধরল ছেলেটা। কুত্তার বাচ্চা। তোমাকে এক্ষুণি তুলে ওই নদীর জলে ফেলে দেব আমি।কোন্ শালা
শুয়োরের বাচ্চা আছে এখানে বাধা
দেয় আমাকে। নৌকা ভেড়াও মাঝি। ওদের তুলে নাও।
কয়েকটা নীরব মুহূর্ত।
নৌকা ভিড়ল। ভয়ে আতঙ্কে অর্ধমৃত বেশ্যাগুলো ভেড়ার পালের মতো নৌকায় এসে চড়ল ।
ছোট বেশ্যা ।। মাঝারি
বেশ্যা।। বড় বেশ্যা ।।
কিশোরী বেশ্যা।। যুবতী
বেশ্যা।। বৃদ্ধা বেশ্যা ।।
ঘৃণায় একপাশে সরে গেল
নৌকার কুলীন যাত্রীরা। বেশ্যারা কোনো কথা বলল না। এক কোণে গাদাগাদি করে বসল ।
অনেকগুলো মুখ।
একটি মুখ আমার মায়ের মতো
দেখতে। মা এখন কী করছে? মায়ের কথা মনে পড়তে বুকটা ব্যথা করে উঠল। ছোট
ভাই। বোন। ইতুদি। ওরা কেমন আছে?
বেঁচে আছে না মরে গেছে? জানি না। হয়তো বহুদিন জানবো না। তবু একটা কথা বারবার মনের মধ্যে উঁকি দেয় আমার। আবার কি
ওদের সঙ্গে একসাথে নাশতার টেবিলে বসতে পারব আমি? আবার
কি রোজ সকালে মা আমার বদ্ধ দুয়ারে এসে কড়া নেড়ে ডাকবে? কী রে,এখনো ঘুমাচ্ছিস?
অনেক বেলা হয়ে গেল যে।
ওঠ। চা খাবি না ?
কিংবা ।দল বেঁধে সবাই
বাড়ির ছাদের ওপরে কেরাম খেলা। পারব কি আবার ?
অথবা ।
মাকে সাক্ষী রেখে,সবাই মিলে বাবার পকেটমারা ? হয়তো!
জানি না ।
জানতে গেলে ভাবনা হয়।
ভাবনাটাই একটা যন্ত্রণা। অথচ ভাবতে আমি এককালে ভীষণ ভালোবাসতাম। বিশেষ করে জয়াকে নিয়ে। চিনু ভাবীর বোন জয়া।
কতভাবে ভেবেছি ওকে।
কখনো সমুদ্রের উত্তাল
পটভূমিতে ।কখনো ঢেউ জাগানো মিছিলের মাঝখানে। কখনো ছোট্ট একটি ঘরের একান্তে। দিনে।
রাতে। অন্ধকারের নিবিড়তায়।
কিংবা কোন দুপুরে।কোন
রেস্তরাঁর কোণের টেবিলে। নিরিবিলি নির্জনে। দু কাপ চা সামনে রেখে অনেকক্ষণ ধরে কোন কথা না বলে বসে থাকার মুহূর্তে।ভাবতে
ভালো লাগে।
ইছামতী,করতোয়া,ময়ূরাক্ষী বলে যে-নদীর
নাম,তার জলে দু’জনে সাঁতার কেটে ঢেউয়ের সঙ্গে কানামাছি খেলতে।
জয়া কোনোদিন সমুদ্র দেখে
নি। সমুদ্র দেখার বড় ইচ্ছে ছিল তার।
একদিন হাসতে হাসতে বলল,জান,সমুদ্র দেখে এলাম।
কখন! কোথায়? অবাক হয়েছিলাম আমি।
কেন,এই শহরে? কপালে জমে ওঠা বিন্দু
বিন্দু ঘাম আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে বলেছিল
জয়া। শহরের অলিতে গলিতে এত সমুদ্রের ছড়াছড়ি জীবনে দেখেছ কখনো ?
জনতার সমুদ্র।
সমুদ্রের চেয়ে গভীর।
সাগরের চেয়েও উত্তাল।
গতিময়।
মনে হচ্ছিল সামনে যত
বাধার পাহাড় আসুক না কেন,সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কোটি কোটি
মুখ।পাথরে খোদাই করা চেহারা। মুষ্টিবদ্ধ হাত সীমানা ছাড়িয়ে। লক্ষ-কোটি বজ্রের শব্দ কিংবা ঢেউয়ের ধ্বনি সে মিছিলের
গর্জনের কাছে অর্থহীন।
আগে তো দেখিনি কোনদিন।
বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে।
চুয়ান্নতে। বাষট্টি ,ছেষট্টি কিংবা ঊনসত্তরে অনেক দেখেছি। কিন্ত এতো
প্রাণের জোয়ার কখনো দেখি নি। এতো মৃত্যুও দেখিনি আগে।
সামনে তাকাই। বিরাট
আকাশ।কয়েকটা লাউয়ের মাচা কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে
আরেকটা গ্রাম।
প্রতিদিন দেখি।
জয়াকেও এত নিবিড় করে
দেখি নি কোনোদিন। পেছনে কয়েকটা বাঁশবন। আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরোনো দালান। সে দালানের গায়ে কাঠ কয়লা
দিয়ে অনেকগুলো ছোট ছোট রেখা
এঁকেছি আমরা। ওগুলো মৃতের হিসেব।
আমাদের নয়। ওদের। যখনি
কোনো শত্রুকে বধ করেছি,তখনই একটা নতুন রেখা টেনে দিয়েছি দেয়ালে। হিসেব
রাখতে সুবিধে হয় তাই। প্রায়ই দেখি।গুনি। তিনশ’ বাহাত্তর
,তিয়াত্তর ,চুয়াত্তর। পুরো দেয়ালটা কবে ভরে যাবে সে প্রতীক্ষায় আছি।
আমাদের যারা মরেছে তাদের
হিসেবও রাখি। কিন্তু সেটা মনে মনে। মনের মধ্যে অনেকগুলো দাগ। সেটাও মাঝে মাঝে
গুনি।
একদিন।
বেশ কিছুদিন
আগে।সেক্টর-কমান্ডার এসেছিলেন আমাদের ক্যাম্পে, দেখতে ।সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা ।অভিবাদন
করেছিলাম তাঁকে।তিনি আমাদের একটি
প্রশ্ন করেছিলেন।
কেন
যুদ্ধ করছ বলতে পার ?
প্রায় এক ধরণের উত্তর
দিয়েছিলাম আমরা।
বলেছিলাম,দেশের জন্যে। মাতৃভূমির জন্যে যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ করছি দেশকে মুক্ত
করার জন্যে।বাংলাদেশ।
না।
পরে মনে হয়েছিল উত্তরটা
বোধহয় ঠিক হয় নি। নিজেরা অনেকক্ষণ আলাপ করেছি আমরা। উত্তরটা ঠিক হল কি?
দেশ তো হল ভূগোলের
ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজারবার সীমারেখা পাল্টায়। পাল্টাচ্ছে। ভবিষ্যতেও
পাল্টাব ।
তাহলে কীসের জন্যে লড়ছি
আমরা?
বন্ধুরা নানাজনে নানারকম
উক্তি করেছিল।
কেউ বলেছিল,আমরা
প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে লড়ছি। ওরা
আমাদের মা-বোনদের কুকুর-বেড়ালের মতো মেরেছ তাই। তার প্রতিশোধ নিতে চাই।
কেউ বলেছিল,আমরা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি।
ওই শালারা বহু অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর। শোষণ করেছে। ওদের তাড়াবার জন্য লড়ছি।
কেউ বলেছিল,অতশত বুঝি না মিয়ারা। আমি শেখ সাহেবের জন্য লড়ছি।
কেউ বলেছিল,কেন লড়ছি জান?
দেশের মধ্যে যত গুণ্ডা,বদমাশ,ঠগ,দালাল,ইতর, মহাজন আর ধর্ম-ব্যবসায়ী আছে তাদের সবার পাছায় লাথি মারতে।
ওদের কথাগুলো শুনছিলাম।
ভাবছিলাম। মাঝে মাঝে আলোচনায় অংশ নিতে গিয়ে তর্ক করছিলাম। কিন্তু মন ভরছিল না।
কিসের জন্যে লড়ছি আমরা? এত প্রাণ দিচ্ছি,এত রক্তক্ষয় করছি?
হয়তো সুখের জন্যে। শান্তির
জন্যে। নিজের কামনা-বাসনাগুলোকে
পরিপূর্ণতা দেবার জন্যে।
কিংবা,শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে।নিজের অস্তিত্ব রক্ষার
জন্যে। অথবা,সময়ের প্রয়োজন। সময়ের প্রয়োজন মেটাবার
জন্যে।
না ।
অতশত ভাবতে পারি না ।আমার
ছোট মাথায় অত ভাবনা এখন আর ধরে না ।ব্যথা করে ।
যেটা বুঝি সেটা সোজা
।আমাদের মাটি থেকে ওদেরকে তাড়াতে হবে। এটাই এখনকার প্রয়োজন।
দেওয়ালের রেখাগুলো
বাড়ছে। মনের দাগও বাড়ছে প্রতিদিন। হাতের কব্জিতে এসে একটা গুলি লেগেছিল কাল ।সেটা হাতে না লেগে বুকেও লাগত.পারত।
মাত্র দু আঙুলের ব্যবধান।
মা কাছে থাকলে হয়তো
মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কাঁদত।বকুনি দিয়ে বলত,বাহাদুর !অত সামনে এগিয়ে
গিয়েছিলি কেন? সবার পেছনে থাকতি পারলি
না? আর অত বাহাদুরির দরকার
নেই বাবা। ঘরের ছেলে এখন ঘরে ফিরে চল।
ভাবতে মন চায়। খবর পেয়েছি মা,বাবা,ভাই, বোন ওরা সবাই
কোথায় যেন চলে গেছে।হয়তো কোন গ্রামে, কোন
গন্জে ।কোন উদ্বাস্তু
শিবিরে। কিংবা-না ।ওটা
আমি ভাবতে চাই না।
জয়ার কোনো খবর
নেই।কোথায় গেল মেয়েটা?
জানি না ।জানতে গেলে ভয়
হয়।
শুধু জানি,এ যুদ্ধে আমরা জিতব। আজ,নয়
কাল। নয়তো পরশু।
একদিন আমি আবার ফিরে যাব।
আমার শহরে,আমার গ্রামে। তখন হয়তো
পরিচিত অনেকগুলো মুখ সেখানে থাকবে
না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব তাদের প্রাণভরে ভালবাসব। যারা নেই,কিন্তু
একদিন ছিল,তাদের গল্প আমি শোনাব
ওদের।
সেই ছেলেটির গল্প ।বুকে
মাইন বেঁধে যে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিংবা,সেই বুড়ো কৃষক।রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল,চললাম। আর ফিরে আসেনি। অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লক্ষ মৃত শিশু।
দশ হাজার গ্রামের আনাচে
কানাচে এক কোটি মৃতদেহ।
না এক কোটি নয়,হয়তো হিসেবের অঙ্ক তখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এক হাজার এক রাত কেটে
যাবে হয়ত। আমার গল্প তবু ফুরোবে না।
সামনে ধানক্ষেত। বিরাট
আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা,কচি লাউ ঝুলছে।দুটো
তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। গ্রামের নাম রোহনপুর।
ওখানে এসে ঘাঁটি পেতেছে
ওরা, একদিন যারা আমাদের অংশ
ছিল।
ডায়েরিতে আর কিছু লেখা
নেই।
খাতাটা
ক্যাম্প-কমান্ডারের দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম,কার
লেখা, আপনার?
না।
আমাদের সঙ্গের এক মুক্তিযোদ্ধার।
তার সঙ্গে একটু আলাপ করতে
পারি কি? আবার প্রশ্ন করলাম।
উত্তর দিতে গিয়ে মুহূর্ত
কয়েক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বললেন,দিন কয়েক আগে একটা
অপারেশনে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছে সে।
তারপর?
তারপরের খবর ঠিক বলতে
পারছি না। হয়তো মেরে ফেলেছে। বেঁচেও থাকতে পারে
সত্যি,মানুষের কল্পনা বড় অদ্ভুত। ঘর-বাড়ি কবে ওরা পুড়ে ছাই করে দিয়েছে ।তবু ঘরের কথা
হয়তো।
চোখজোড়া অজান্তে আবার
খাতাটার ওপরে নেমে এল। অনেকক্ষণ উল্টে পাল্টে দেখলাম সেটা। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম বাইরের দিকে।বিরাট
আকাশ।একটা লাউয়ের মাচা,কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ। দূরে আরেকটা গ্রাম। সেখানে আগুন
জ্বলছে।