হুমায়ূন আহমেদ

পরিচিতি : হুমায়ূন আহমেদ ( ১৩ নভেম্বর , ১৯৪৮ — ১৯ জুলাই , ২০১২ ) বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। ত... thumbnail 1 summary


পরিচিতি: হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮১৯ জুলাই, ২০১২) বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক গণ্য করা হয়। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক । এই কালপর্বে তাঁর গল্প-উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ছিল তুলনারহিত। তাঁর সৃষ্ট হিমু মিসির আলি চরিত্রগুলি বাংলাদেশের যুবকশ্রেণীকে গভীরভাবে উদ্বেলিত করেছে। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহ পেয়েছে অসামান্য দর্শকপ্রিয়তা। তবে তাঁর টেলিভিশন নাটকগুলি ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। সংখ্যায় বেশী না হলেও তাঁর রচিত গানগুলোও সবিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস হলো নন্দিত নরকে, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া ইত্যাদি। তাঁর নির্মিত কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো দুই দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেঁটুপুত্র কমলা ইত্যাদি।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘকাল কর্মরত ছিলেন।[৩] লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে তিনি অধ্যাপনা ছেড়ে দেন। 




ছোটগল্প
পাপ
ভাই আপনাকে একটা ভয়ঙ্কর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করিনি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীর কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক, মূল গল্পটা বলি।
আমি তখন মাধবখালি ইউনিয়নে মাস্টারি করি। গ্রামের নাম ধলা। ধলা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নতুন বিবাহ করেছি। স্ত্রী সঙ্গে থাকেন। আমার বয়স তখন পঁচিশের মতো হবে। স্ত্রী নিতান্তই বালিকা। পনের-ষোল মতো বয়স। ধলা গ্রামে আমরা প্রথম সংসার পাতলাম। স্কুলের কাছেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমার টিনের ঘর। আমরা সুখেই ছিলাম। ফুলির গাছগাছালির খুব শখ। সে গাছপালা দিয়ে বাড়ী ভরে ফেলল। ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি। ফুলি আমার স্ত্রীর ডাক নাম। ভালো নাম নাসিমা খাতুন।
বুঝলেন ভাই সাহেব, ধলা বড় সুন্দর গ্রাম। একেবারে নদীর তীরের গ্রাম। নদীর নাম কাঞ্চন। মাছ খুবই সস্তা। জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে বাড়ীতে দিয়ে যায়। তার স্বাদই অন্যরকম। পনের বছর আগের কথা বলছি। এখনও সেখানকার পাবদা মাছের স্বাদ মুখে লেগে আছে। শীতের সময় বোয়াল মাছ থাকতো তেলে ভর্তি।
ধলা গ্রামের মানুষজনও খুব মিশুক। আজকাল গ্রাম বলতেই ভিলেজ পলিটিক্সের কথা মনে আসে। দলাদলি, কাটাকাটি, মারামারি। ধলা গ্রামে এসব কিছুই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আমার অন্যরকম মর্যাদা ছিল। যে-কোন বিয়ে শাদিতে আদর করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেত। গ্রাম্য সালিসিতে আমার বক্তব্য গুরুত্বের সাথে নেয়া হতো। দুই বছর খুব সুখে কটলো। তারপরই সংগ্রাম শুরু হলো। আপনারা বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রামের লোকের কছে সংগ্রাম।
ধলা গ্রাম অনেক ভিতরের দিকে। পাক বাহিনী কোন দিন ধলা গ্রামে আসবে আমরা চিন্তাই করি নি। কিন্তু জুন মাসের দিকে পাক বাহিনীর গান বোট কাঞ্চন নদী দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাধবখালি ইউনিয়নে মিলিটারি ঘাঁটি করলো। শুরু করলো অত্যাচার। তIদের অত্যাচারের কথা আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নেই। আপনি আমার চেয়ে হাজার গুণে বেশি জানেন। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। কাঞ্চন নদীর একপাড়ে ধলা গ্রাম, অন্য পাড়ে চর হাজরা। জুন মাসের ১৯ তারিখ চর হাজরা গ্রামে মিলিটারির গানবোট ভিড়ল। চর হাজরার বিশিষ্ট মাতবর ইয়াকুব আলী সাহের মিলিটারিদের খুব সমাদর করে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ভাই সাহেব, আপনি এর অন্য অর্থ করবেন না। তখন তাদের সমাদর করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সবারই হাত-পা ছিল বাঁধা। ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারিদের খুব আদর-যত্ন করলেন। ডাব পেড়ে খাওয়ালেন। দুপুরে খানা-খাওয়ার জন্য খাসি যবেহ করলেন। মিলিটারিরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলো। খানা পিনা করলো। যাবার সময় ইয়াকুব আলী সাহেবের দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এখন গল্পের মতো মনে হয়। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য। আমার নিজের দেখা। সেই দিনের খানায় শরীক হওয়ার জন্য ইয়াকুব আলী সাহেব আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম।
চরহাজরার ঘটনার পর আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। গজবের হাত থেকে বাঁচার জন্য মসজিদে কোরআন খতম দেয়া হলো। গ্রাম বন্ধ করা হলো। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার সুরা এখলাস পাঠ করা হলো। কী যে অশান্তিতে আমাদের দিন গিয়েছে ভাই সাহেব। আপনাকে কী বলব। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। আমার স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা।সাত মাস চলছে। হাতে নাই একটা পয়সা। স্কুলের বেতন বন্ধ। গ্রামের বাড়ী থেকে যে টাকা পয়সা পাঠাবে সে উপায়ও নাই। দেশে যোগাযোগ বলতে তখন কিছুই নাই। কেউ কারো খোঁজ জানে না। কী যে বিপদে পড়লাম। সোবহানাল্লাহ।
বিপদের উপর বিপদ-জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী দেখা দিল। নৌকায় করে আসে, দুই একটা ফুটফাট করে উধাও হয়ে যায়। বিপদে পড়ি আমরা। মিলিটারি এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তখন আর কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হলো। মুক্তিবাহিনী তখন আর শুধু ফুটফাট করে না। রীতিমতো যুদ্ধ করে। ভালো যুদ্ধ। বললে বিশ্বাস করবেন না, এরা কাঞ্চন নদীতে মিলিটারির একটা লঞ্চ ডুবিয়ে দিল। লঞ্চ ডুবার ঘটনা ঘটলো সেপ্টেম্বর মাসের ছাব্বিশ তারিখ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। ভাই সাহেব হয়তো শুনেছেন, বলা হয়েছিল শতাধিক মিলিটারির প্রাণ সংহার হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক না। মিলিটারি অল্পই ছিল। বেশির ভাগই ছিল রাজাকার। রাজাকারগুলো সাঁতরে পাড়ে উঠেছে, গ্রামের লোকরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস ভাই সাহেব। যুদ্ধ অতো সাধারণ মানুষকেও হিংস্র করে ফেলে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।
এখন মূল গল্পটা আপনাকে বলি। সেপ্টেম্বর মাসের আটাশ তারিখের ঘটনা। মাগরেবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছি। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। একা একা বৃষ্টি দেখছি। আমার স্ত্রী শোবার ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার শরীর খুব খারাপ। দুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছে না। যা খায় তাই বমি করে দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। কোন কিছু না ধরে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ডাক্তার যে দেখাব সে উপায় নাই। ডাক্তার পাবো কই? মাধব খালিতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। বাবু নলিনীকুমার রায়। ভালো ডাক্তার। মিলিটারি মাধবখালিতে এসে প্রথম দিনই তাকে মেরে ফেলেছে।
যে কথা বলছিলাম, আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। মন অত্যন্ত খারাপ।
বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। একসময় প্রায় ঝড়ের মতো শুরু হলো। বাড়ী-ঘড় কাঁপতে শুরু করলো। আমি একটু দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পুরনো নড়বড়ে বাড়ী। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়বো। কাছেই মোক্তার সাহেবের পাকা দালান। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠবো কি-না ভাবছি। তখন ফুলি আমাকে ভেতর থেকে ডাকলো। আমি অন্ধকারে ঘরে ঢুকলাম। ফুলি ফিসফিস করে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
আমি বললাম, কী কথা?
ফুলি বলল, আমার কাছে আগে বসো। আমি বসলাম। ফুলি বলল, আমি যদি তোমার কাছে কোন জিনিস চাই তুমি আমাকে দিবে?
আমি বললাম, ক্ষমতার ভিতরে থাকলে অবশ্যই দিবো। আকাশের চাদ চাইলে তো আর দিতে পারবো না। জিনিসটা কী?
তুমি আগে আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, প্রতিজ্ঞা করলাম। এখন বলো ব্যাপার কী?
হ্যারিকেনটা জ্বালাও।
হ্যারিকেনটা জ্বালালাম। দেখি তার বালিশের কাছে একটা কোরআন শরীফ। আমাকে বলল, আল্লাহ পাকের কালাম ছুয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি কথা রাখবে।
আমি ধাঁ ধাঁর মধ্যে পড়ে গেলাম। ব্যাপার কী? পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের মধ্যে অনেক পাগলামী ভর করে। আমি ভাবলাম এরকমই কিছু হবে। দেখা যাবে আসল ব্যাপার কিছু না। আমি কোরআন শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর বললাম, এখন বলো আমাকে করতে হবে কী?
একটা মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
একটা মানুষ আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার জীবন রক্ষা করতে হবে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার কাছে আশ্রয় নিল?
ফুলি থেমে থেমে চাপা গলায় যা বললো তাতে আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। দুদিন আগে মিলিটারির লঞ্চডুবি হয়েছে। একটা মিলিটারি নাকি সাঁতরে কুলে উঠেছে। আমাদের বাড়ীর পেছন দিকে কলাগাছের ঝোপের আড়ালে বসে ছিল। ফুলিকে দেখে বহেনজি বলে ডাক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। ফুলি তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, দুদিন ধরে একটা মিলিটারি আমাদের বাড়ীতে আছে?
ফুলি বলল, হু!
সত্যি কথা বলছো।
হাঁ সত্যি, এখন তুমি তাকে মাধবখালি নিয়ে যাও। মাধবখালিতে মিলিটারি ক্যাম্প আছে। আজ ঝড়বৃষ্টির রIত আছে।অন্ধকারে অন্ধকারে চলে যাও। কেউ টের পাবে না।
তোমার কী মাথা খারাপ।
আমার মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক, তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমি মিলিটারি নিয়ে রওনা হব। পথে আমাকে ধরবে মুক্তিবাহিনী। দুজনকেই গুলি করে মারবে!
এইরকম ঝড়-বৃষ্টির রাতে কেউ বের হবে না। তুমি রওনা হয়ে যাও।
ব্যাটা আছে কোথায়?
আস তোমাকে দেখাই।
সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র কী আছে?
কিছুই নাই। খালি হাতে সাঁতরে পাড়ে উঠেছিল।
আমি মোটেই ভরসা পেলাম না। অস্ত্র থাকুক আর না থাকুক মিলিটারি বলে কথা। জেনেশুনে এরকম বিপজ্জনক শত্রু শুধুমাত্র মেয়েছেলেদের পক্ষেই ঘরে রাখা সম্ভব। আমর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, হারামজাদা কই?
ফুলি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এমনিতে সে কোনকিছু না ধরে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আজ দেখি হ্যারিকেন হাতে গটগট করে যাচ্ছে।
রান্না ঘরের পাশে ভাড়ার ঘর জাতীয় ছোট একটা ঘর আছে। সেখানে চাল ডাল পিয়া-টিয়াজ থাকে। ফুলি আমাকে সেই ঘরের কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঘরটা তালাবদ্ধ। একটা মাস্টারলক তালা ঝুলছে। ফুলি তালা খুলল। হ্যারিকেন উঁচু করে ধরলো। দেখি ঘরের কোনায় কম্বল বিছানো। কম্বলের উপর নিতান্তই অল্প বয়সি একটা ছেলে বসে আছে। তার পরণে আমার লুঙ্গি, আমার পাঞ্জাবি। ঘরের এককোণায় পানির জগ-গ্লাস। পাকিস্তানি মিলিটারির সাহসের কত গল্প শুনেছি। এখন উল্টা জিনিস দেখলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। গুটিশুটি মেরে গেল। ফুলি তাকে ইশারায় বলল, ভয় নাই।
আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এতো কাছে থেকে আগে কখনও মিলিটারি দেখিনি। এই প্রথম দেখছি। লুঙি পাঞ্জাবি পড়া বলেই বোধ হয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙালির মতো। শুধু রঙটা বেশি ফর্সা আর নাকমুখ কাটা কাটা।
আমি ফুলিকে বললাম --এর নাম কী?
ফুলি গড়গড় করে বলল, এর নাম দিলদার। লেফটেন্যান্ট। বাড়ী হলো বালাকোটে। রেশমি নামে ওদের গাঁয়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে গিয়ে সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। রেশমি যে কতো সুন্দর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অবিকল ডানাকাটা পরী। রেশমির ছবি দেখবে? দিলদারের পকেটে সবসময় রেশমির ছবি। বালিশের নীচে এই ছবি না রাখলে সে ঘুমুতে পরে না।
কারো ছবি দেখারই আমার কোন শখ ছিল না। আমার মাথা তখন ঘুরছে। এক সমস্যায় পড়লাম। ফুলি তারপরও একটা ছবি দেখাল। ঘাগরা পড়া একটা মেয়ে। মুখ হাসি হাসি। ফুলি বলল, মেয়েটা সুন্দর কেমন দেখলে!
আমি বললাম, হু
এখন তুমি ওকে মাধবখালি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই কর।
দেখি।
দেখাদেখির কিছু না। তুমি রওনা হও।
মাধবখালি তো পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। নৌকা লাগবে।
নৌকার ব্যবস্থা কর। ওকে পার করার জন্য আজ রাতই সবচেয়ে ভালো। ভয়ে বেচারা অস্থির হয়ে গেছে। পানি ছাড়া কিছু খেতে পারছে না।
আমি শুকনা গলায় বললাম, দেখি কী করা যায়।
ফুলি মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বল, তোমার আর কোন ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারি বাংলা ভাষার কী বুঝলো কে জানে। সে শুধু বললো, শুকরিয়া বহেনজি। লাখো শুকরিয়া।
ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসল। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না--চলে যাও।
আমি ছাতা হাতে বাড়ী থেকে বের হলাম। তখনও ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কী করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি, আল্লাহ পাকের কালাম ছুয়ে প্রতিঞ্জা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্য মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে-সাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবারঅন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকIর মাঝিই বলে দিবে। কোনকিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসাবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু থু দিবে। পকিস্থানি মিলিটারি শুধু আমাদের পরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাৎ শয়তান। এদের কোন ক্ষমা নাই।
আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দুটার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে সে রাতেই গুলি করে মারা হলো। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবর আমার স্ত্রীকে ডাকলো, বহেনজি, বহেনজি।
আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালই হলো। বেঁচে থাকলে সারা জীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচতো। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ। বুঝলেন ভাই সহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মতো সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করলো চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পূণ্য কিভাবে বিচার করেন, আমাকে কী শাস্তি দেন, এটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা।
আনন্দ বেদনার কাব্য

বইটির নাম 'রিক্তশ্রী পৃথিবী'
প্রচ্ছদে একটি মেয়ের মুখের ছবি। মেয়েটি কাঁদছে। তার মুখের পাশে একটি গ্লোব। একটি বিকটদর্শন নর-কঙ্কাল গ্লোবটি বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। কঙ্কালটির ডান হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। যথেষ্ট জটিলতা। পৃথিবীর রিক্তশ্রী ফুটিয়ে তোলার আয়োজনে কোনো ত্রুটি নেই। এ ধরনের প্রচ্ছদচিত্রের বইগুলোর পাতা সাধারণত উল্টানো হয় না।
তবুও অভ্যাসবশেই পাতা উল্টালাম। এবং এক সময় দেখি গ্রন্থকারের লেখা ভূমিকাটি পড়তে শুরু করেছি। শুরু না করলেই বোধহয় ভালো ছিল। ভূমিকাটিতে খুব মন খারাপ করা একটি ব্যাপার আছে। আমার নিজের যথেষ্ট দুঃখ-কষ্ট আছে, অন্যের দুঃখ-কষ্ট আর ছুঁতে ইচ্ছে করে না। গ্রন্থকার লিখেছেন, "দীর্ঘ পাঁচ বছর পূর্বে 'রিক্তশ্রী পৃথিবী'র পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করি। সেই সময় আমার অতি আদরের জ্যেষ্ঠ কন্যা মোসাম্মৎ নুরুন্নাহার খানম (বেনু) উক্ত গ্রন্থের জন্যে প্রচ্ছদচিত্রটি অঙ্কন করে। অর্থাভাবে তখন গ্রন্থটি প্রকাশ করিতে পারি নাই। আজ প্রকাশিত হইল। কিন্তু হায়, আমার বেনু মা দেখিতে পাইল না।"
বইটির দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রচ্ছদশিল্পীর সামান্য একটু পরিচয়ও আছে। সেখানে লেখা প্রচ্ছদশিল্পী : মোসাম্মৎ নুরুন্নাহার খানম। দশম শ্রেণী, বিজ্ঞান বিভাগ।
মফস্বল থেকে প্রকাশিত বইটি হঠাৎ করেই অসামান্য হয়ে উঠল আমার কাছে। এই বইটি ঘিরে দরিদ্র পরিবারের আশা-আকাঙ্ক্ষার ছবিটি চোখের সামনে দেখতে পেলাম। লম্বা বেণির দশম শ্রেণীর কালোমতো রোগা একটি মেয়ে যেন গভীর ভালোবাসায় বাবার বইয়ের জন্যে রাত জেগে প্রচ্ছদ আঁকছে। আঁকা হবার পর বাবাকে দেখাল সেটি। পৃথিবীর সব বাবাদের মতো এই বাবাও মেয়ের শিল্পকর্ম দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন। রাতে সবাই খেতে বসেছে। দরিদ্র আয়োজন। কিন্তু সবার মুখ হাসি-হাসি। বাবা বললেন, পাস করলে আমার বেনু-মাকে আমি আর্ট কলেজে দেবো। বেনু বেচারি লজ্জায় মরে যায়। ভাত মাখতে মাখতে বলল, দূর ছাই, মোটেও ভালো হয়নি। বাবা রেগে গেলেন, ভালো হয়নি মানে? আঁকুক দেখি কেউ এ রকম একটা ছবি।
বই অবশ্যি বাবা প্রকাশ করতে পারলেন না। কে ছাপবে এ রকম বই? দু'একজন প্রকাশক বলেও ফেলল, এসব পদ্যের বই কি আজকাল চলেরে ভাই? এসব নিজের পয়সায় ছাপতে হয়। টাকা জমান, জমিয়ে নিজেই ছাপান।
প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করতে বাবার দীর্ঘ পাঁচ বছর লাগল। হয়তো স্ত্রীর কানের দুলজোড়া বিক্রি করতে হলো। সে বছর ঈদে বাচ্চারা কেউ কাপড় নিল না। তিনি খুঁজে পেতে সস্তার একটি প্রেস বের করলেন, যার বেশির ভাগ টাইপই ভাঙা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ প্রেসের মালিক সালাম সাহেব, গ্রন্থকারের কবিতার একজন ভক্ত। গ্রন্থকার লিখেছেন, 'টাউন প্রেসের স্বত্বাধিকারী জনাব আব্দুস সালাম সাহেব আমার এই গ্রন্থখানি প্রকাশের ব্যাপারে প্রভূত সাহায্য করিয়াছেন। এই কাব্যানুরাগী বন্ধুবৎসল মানুষটির সহযোগিতা ব্যতীত এই গ্রন্থ আপনাদের হাতে তুলিয়া দেওয়া আমার সাধ্যাতীত ছিল। জনাব আব্দুস সালাম সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়া ছোট করার ধৃষ্টতা আমার নাই।'
ভূমিকা থেকে বোঝা যাচ্ছে কবি সন্ধ্যাবেলায় প্রুফ দেখতে যখন যেতেন তখন সালাম সাহেব হাসিমুখে বলতেন, এই যে কবি সাহেব, আসেন, আপনার সেকেন্ড প্রুফ রেডি। কই রে কবি সাহেবের জন্যে চা আন। চা খেতে খেতে বললেন, প্রুফে চোখ বুলাতে বুলাতে আপনার একটা কবিতা পড়েই ফেললাম। বেশ লিখেছেন।
কোন কবিতাটির কথা বলছেন?
ঐ যে কী যেন বলে, ইয়ের উপর যেটা লিখলেন। বৃষ্টি বাদলার কথা আছে যেটায়।
, 'নব-বর্ষা'র কথা বলছেন?
হ্যাঁ, ঐটাই। চমৎকার। খুবই ভাবের কথা। আপনি তো ভাই বিরাট লোক। কবি নিশ্চয়ই বই ছাপানোর সব টাকা আব্দুস সালাম সাহেবকে দিতে পারেননি। সালাম সাহেব বললেন, যখন পারেন দিবেন। কবি মানুষ আপনি।
আপনার কাছে টাকা মার যাবে নাকি হা হা হা। ক'জন পারে আপনার মতো কবিতা লিখতে?
ভূমিকা পড়েই জানতে পারলাম নেত্রকোনা শহরের একজন প্রবীণ উকিল বাবু নলিনী রঞ্জন সাহাও জনাব আবদুস সালামের মতো কবির প্রতিভায় মুগ্ধ। কবি লিখেছেন, "বাবু নলিনী রঞ্জন সাহার উৎসাহ ও প্রেরণা আমাকে গ্রন্থখানি প্রকাশ করিবার জন্য আগ্রহী করিয়াছে। বাবু নলিনী রঞ্জন একজন স্বভাব-কবি এবং কাব্যের একজন কঠিন সমালোচক। তিনি যখন আমার কবিতা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক পত্রিকা 'মঞ্জুষা'তে আমার একটি কবিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া বলিলেন, এই কবির কাব্যগ্রন্থ অনতিবিলম্বে প্রকাশ হওয়া বাঞ্ছনীয়, তখনই আমি স্থির করি ...।"
'
রিক্তশ্রী পৃবিবী'তে মোট একশ' তেরোটি কবিতা আছে। প্রতিটি কবিতার নিচে রচনার স্থান, তারিখ এবং সময় দেয়া আছে। অনেকগুলোর সঙ্গে বিস্তৃত ফুটনোট। কয়েকটি উল্লেখ করি। 'দিবাবসান' কবিতাটির ফুটনোটে লেখা, 'আমার বড় শ্যালক জনাব আমীর সাহেবের বাড়িতে এই কবিতাটি রচিত হয়। তাহার বাড়ির সনি্নকটে খরস্রোতা একটি নদী আছে (নাম স্মরণ নাই)। উক্ত নদীর তীরে এক সন্ধ্যায় বসিয়াছিলাম। দিবাবসানের পরপরই আমার মনে গভীর আবেগের সৃষ্টি হয়। কবিতা রচনার উপকরণ সঙ্গে না থাকায় আবেগটি যথাযথ ধরিয়া রাখিতে পারি নাই। সমস্ত কবিতাটি মনে মনে রচিত করিয়া পরে লিপিবদ্ধ করিতে হইয়াছে।'
অন্য একটি কবিতার (বাসর শয্যা) ফুটনোটটি এ রকম_ 'এই দীর্ঘ কবিতাটি আমি আমার বাসর রাত্রে রচনা করিয়াছি। সেই সময় বাহিরে খুব দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ছিল। প্রচণ্ড হাওয়া এবং অবিশ্রান্ত বর্ষণ। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাইতে ছিল। আমার নবপরিণীতা বালিকাবধূ মেঘগর্জনে বারবার কাঁপিয়া উঠিতে ছিল।'
বাসর রাত্রিতে স্বামীর এই কাব্যরোগ দেখে নতুন বৌটি নিশ্চয়ই দারুণ অবাক হয়েছিল। তার চোখে ছিল বিস্ময় এবং হয়তো কিছুটা ভয়। কবি স্বামী দীর্ঘ রচনাটি কি সেই রাত্রেই পড়ে শুনিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে? না শুনিয়ে কি পারেন? ঝড় জলের রাত। হাওয়ার মাতামাতি। টাটকা নতুন কবিতা। রহস্যমণ্ডিত এক নারী। সেই রাত কী যে অপূর্ব ছিল সেটি আমরা ফুটনোট পড়ে কিছুটা বুঝতে পারি।
এবং এও বুঝতে পারি, যে লোক বিয়ের রাতে সাড়ে ছ'পৃষ্ঠার একটি কবিতা লিখতে পারেন, তিনি পরবর্তী সময়ে কী পরিমাণ বিরক্তি ও হতাশার সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্ত্রী মনে। ঘরে হয়তো টাকা-পয়সা নেই। ছোট ছেলের জ্বর। তার জন্যে সাগু কিনে আনতে হবে। কিন্তু ছেলের বাবা কবিতার খাতা নিয়ে বসেছেন। গভীর ভাবাবেগে তাঁর চোখে চল। লিখছেন 'একদা জ্যোৎস্নায়' নামের দীর্ঘ কোনো রচনা। কেন কিছু কিছু মানুষ এমন নিশি-পাওয়া হয়? দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-বঞ্চনা কিছুই তাঁদের স্পর্শ করে না। স্বর্গীয় কোনো একটি হিংস্র পশু তাঁদের তাড়া করে ফিরে। কেন করে? আমার উত্তর জানা নেই। জানতে ইচ্ছে হয়।
এইসব নিশি-পাওয়া মানুষদের বেশিরভাগই নিজের ক্ষুদ্র পরিবার এবং কয়েকজন ভালো মানুষ বন্ধু-বান্ধব ছাড়া আর কারও কাছে তাঁদের আবেগের কথা পেঁৗছাতে পারেন না। কৃপণ ঈশ্বর এদেরকে আবেগে উদ্বেলিত হবার মতো অপূর্ব একটি হৃদয় দিয়ে পাঠান, কিন্তু সেই আবেগকে প্রবাহিত করবার মতো ক্ষমতা দেন না। এরা বড় দুঃখী মানুষ।
'
রিক্তশ্রী পৃথিবী'র পাতা উল্টাতে উল্টাতে আমার এমন কষ্ট হলো। কবি কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে কত আজেবাজে জিনিসই না লিখেছেন। ইরানের শাহকে নিয়ে পর্যন্ত একটা কবিতা আছে। কী আছে এই স্বৈরাচারী রাজার মধ্যে যে তাকে নিয়ে পর্যন্ত একটা কবিতা লিখতে হলো? তিনটি কবিতা আছে মহাসাগর নিয়ে। কবি কিন্তু সাগর-মহাসাগর কিছুই দেখেননি। [সমুদ্র দেখিবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। তবে বহুবার আমি মনশ্চক্ষে সমুদ্র দেখিয়াছি। ফুটনোট, 'হে মহাসিন্ধু'।]
কবিতা আমি পড়ি না। কিন্তু 'রিক্তশ্রী পৃথিবী'র প্রতিটি কবিতা আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। কিছুই নেই। কষ্টে সঞ্চিত শেষ মুদ্রাটিও নিশ্চয়ই চলে গেছে এই বইয়ে। বাকি জীবন এই পরিবারটি অবিক্রীত গ্রন্থটির প্রতিটি কপি গভীর আগ্রহে আগলে রাখবে। প্রাণে ধরে সের দরে বিক্রি করতে পারবে না। বইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী মাঝে মাঝে গোপনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলবেন। কিন্তু তাতে কী আছে? অন্তত একটি দিনের জন্যে হলেও তো এই পরিবারটিতে আনন্দ এসেছিল। কবি-স্ত্রী মুগ্ধচোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলেন, আমার স্বামী তাহলে সত্যি সত্যি একটি বই লিখে ফেলেছেন? ছেলেমেয়েরা বাবার বই নিয়ে ছুটে গেছে বন্ধু-বান্ধবদের দেখাতে।
বাবা প্রথমবারের মতো বুক উঁচু করে তাঁর বড় সাহেবের ঘরে ঢুকে বলেছেন, স্যার, আপনার জন্যে একটা বই আনলাম। বড় সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আরে আপনি আবার বই লিখলেন কবে?
স্যার, প্রচ্ছদটা আমার মেয়ের আঁকা।
তাই নাকি? বাহ্ চমৎকার।
'
রিক্তশ্রী পৃথিবী'র শেষ কবিতাটি সম্পর্কে বলি। শেষ কবিতাটির নাম_ 'মাগো'। কবিতাটি নূরুন্নাহার খানমকে নিয়ে লেখা। ফুটনোট থেকে জানতে পারি, মৃত্যুর আগের রাতে সে যখন রোগযন্ত্রণায় ছটফট করছিল তখন তার অসহায় বাবা এই কবিতাটি লিখে এনেছিলেন মেয়েকে কিঞ্চিৎ 'উপশম' দেবার জন্যে। কবিতাটি ক্ষুদ্র এবং রচনাভঙ্গি অন্য কবিতার মতোই কাঁচা। কিন্তু প্রতিটি শব্দ চোখের গহীন জলে লেখা বলেই বোধকরি কবিতাটি দুঃখী বাবার মতোই হাহাকার করে উঠে। সেই হাহাকার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে চলে যায় অদেখা সব ভুবনের দিকে।
একটিমাত্র কবিতা লিখেও কেউ কেউ কবি হতে পারেন। অল্প কিছু পঙ্ক্তিমালাতেও ধরা দিতে পারে কোনো এক মহান বোধ, মহান আনন্দ, জগতের গভীরতম ক্রন্দন। সেই অর্থে আমাদের 'রিক্তশ্রী'র কবি একজন কবি।

জলিল সাহেবের পিটিশন
তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আমি দুজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাবা। সেভেনটি ওয়ানে আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ভদ্রলোকের চেহারা বিশেষত্বহীন। বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। সে তুলনায় বেশ শক্ত-সমর্থ। বসেছেন মেরুদণ্ড সোজা করে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ । চশমা-টশমা নেই। তার মানে, চোখে ভালোই দেখতে পান। আমি বললাম, আমার কাছে কী ব্যাপার?
ভদ্রলোক যেভাবে বসেছিলেন, সেভাবেই বসে রইলেন। সহজ সুরে বললেন, ‘একজনের ডেডবডি পেয়েছিলাম। মালিবাগে কবর দিয়েছি। আমার ছোট মেয়ের বাড়ি আছে মালিবাগে।
:
তাই নাকি?
:
জি, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া।
:
আমার কাছে কেন এসেছেন?
:
গল্পগুজব করতে আসলাম। নতুন এসেছেন এ পাড়ায়। খোঁজ-খবর করা দরকার। আপনি আমার প্রতেবেশী।
ভদ্রলোক হাসি মুখে বসে রইলেন। আমার সন্দেহ হলো, তিনি সত্যি সত্যি হাসছেন না। তার মুখের ফাটাটাই হাসি হাসি। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি আপনার পাশের গলিতেই থাকি।
:
তাই নাকি?
আমি দেখিনি। তবু মাথা নাড়ালাম। ভদ্রলোকের চরিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সম্ভবত অবসর জীবন যাপন করেছেন। কিছুই করার দরকার নেই। সময় কাটানোই বোধ হয় তার এখন সমস্যা। যার জন্য ছুটির দিনে প্রতিবেশী খুঁজতে হয়।
:
আমার নাম আব্দুল জলিল।
আমি নিজের নাম বলতে গেলাম। ভদ্রলোক বলতে দিলেন না! উঁচু গলায় বললেন, ‘চিনি, আপনাকে চিনি।
:
চা খাবেন? চায়ের কথা বলি?
:
জি না। আমি চা খাই না। চা-সিগারেট কিছুই খাই না। নেশার মধ্যে, পান খাই।
পান তো দিতে পারব না। এখানে কেউ পান খায় না।
:পান আমার সঙ্গেই থাকে। ভদ্রলোক কাঁধের ঝোলাতে হাত ঢুকিয়ে পানের কৌটা বের করলেন। বেশ বাহারি কৌটা। টিফিন কেরিয়ারের মতো তিন-চারটা আলাদা বাটি আছে। আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করলাম। ভদ্রলোক লম্বা পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন। সারা সকালটাই হয়তো এখানে কাটাবেন। দুঃখ-কষ্টের গল্প অন্যকে শোনাতে সবাই খুব পছন্দ করে। ভদ্রলোক একটু ঝুঁকে এসে বললেন, ‘প্রফেসার সাহেব, আপনি একটা পান খাবেন?’
:
জি না।
:
পান কিন্তু শরীরের জন্য ভালো। পিত্ত ঠান্ডা রাখে। যারা পান খায়, তাদের পিত্তের দোষ হয় না।
:
তাই নাকি?
:
জি। পানের রস আর মধু হলো গিয়ে বাতের খুব বড় ওষুধ।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে দশটা। আজ ইউনিভার্সিটি নেই। থাকলে ভালো হতো। বলা যেত, ‘কিছু মনে করবেন না, এগারটার সময় একটা ক্লাস আছে, আপনি অন্য আরেক দিন সময় হাতে নিয়ে আসুন।ছুটির দিনে এ রকম কিছু বলা যায় না।
ভদ্রলোক তার পানের কৌটা খুলে নানা রকম মসলা বের করলেন। প্রতিটি শুঁকে শুঁকে দেখলেন। পান বানালেন অত্যন্ত যত্নে। যিনি পান বানানোর মতো তুচ্ছ ব্যাপারে এতটা সময় নষ্ট করেন, তিনি যে আজ দুপুরের আগে নড়বেন না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু আশ্চর্য, ভদ্রলোক পান মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। হাসি মুখে বললেন, ‘যাই, আমি অনেকটা সময় নষ্ট করলাম।বিস্ময় সামলে আমি আন্তরিকভাবেই বললাম, ‘বসুন, এত তাড়া কিসের?’ তিনি বললেন, ‘না।আমি তাঁকে সিঁড়ি

পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ফেরার পথে দেখি, বাড়িওয়ালা ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘প্রফেসর সাহেবকে ধরেছে বুঝি? সিগনেচার করেছেন?’
:
কী সিগনেচার?
:
জলিল সাহেবের পিটিশনে সিগনেচার করেননি?
:
পিটিশনটা কিসের?
:
আমাকে বলতে হবে না। নিজেই টের পাবেন। হাড় ভাজা করে দেবে। কোনো প্রশ্রয় দেবেন না।
অস্পষ্ট একটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। নতুন পাড়ায় আসার অনেক বিরক্তিকর ব্যাপার আছে। নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হতে হয়। সে পরিচয় অনেক সময়ই সুখকর হয় না। তবে জলিল সাহেব প্রসঙ্গে ভয়টা বোধ হয় অমূলক। এরপর তাঁর সঙ্গে দুবার দেখা হলো। বেশ সহজ-স্বাভাবিক মানুষ। একবার দেখা গ্রিন ফার্মেসির সামনে। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন,—প্রফেসর সাহেব না? ভালো আছেন?
:
জি, ভালো। আপনি ভালো আছেন? কই, আর তো আসলেন না?
:
সময় পাই না। খুব ব্যস্ত পিটিশনটার ব্যাপারে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ক্লাসের দোহাই দিয়ে রিকশায় উঠে পড়লাম। দ্বিতীয়বার দেখা হলো নিউ মার্কেটের একটা নিউজ স্ট্যান্ডের সামনে। দেখি, তিনি উবু হয়ে বসে একটির পর একটি পত্রিকা খুব দ্রুত পড়ে শেষ করছেন। হকার ছেলেটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাঁকে দেখছে।
:
কী জলিল সাহেব, কী পড়ছেন এত মন দিয়ে?
জলিল সাহেব আমার দিকে তাকালেন। মনে হয়, ঠিক চিনতে পারছেন না। তাঁর চোখে চশমা।
:
চশমা নিয়েছেন নাকি?
:
জি। সন্ধ্যা হলে মাথা ধরে। প্লাস পাওয়ার। ভালো আছেন, প্রফেসার সাহেব?
:
জি, ভালো।
:
যাব একদিন আপনার বাসায়। পিটিশনটা দেখাব আপনাকে। চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচার জোগাড় হয়েছে।
:
কিসের পিটিশন?
:
পড়লেই বুঝবেন। আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আপনাদের বুঝতে কষ্ট হবে না।
আমার ধারণা ছিল, সরকারের কাছে কোনো সাহায্য চেয়ে পিটিশান করা হয়েছে। সেখানে চৌদ্দ হাজার সিগনেচারের ব্যাপারটা বোঝা গেল না। আমি নিজে থেকেও কোনো আগ্রহ দেখালাম না। জগতে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কম নয়। সিগনেচার সংগ্রহ যদি কারও নেশা হয়, তা নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু উদ্বিগ্ন হতে হলো। জলিল সাহেব এক সন্ধ্যায় তাঁর চৌদ্দ হাজার তিন শ সিগনেচারের ফাইল নিয়ে আমার বাসায় উপস্থিত হলেন। হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ভালো করে পড়েন, প্রফেসর সাহেব।আমি পড়লাম। পিটিশনের বিষয়বস্তু হচ্ছেদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দশ লাখ ইহুদি মারা গিয়েছিল। সেই অপরাধে অপরাধীদের প্রত্যেকের বিচার করা হয়েছে এবং এখনোহচ্ছে। কিন্তু এ দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ মেরে অপরাধীরা কি করে পার পেয়ে গেল? কেন এ নিয়ে আজ কেউ কোনো কথা বলছে না। জলিল সাহেব তাঁর দীর্ঘ পিটিশনে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন, যেন এদের বিচার করা হয়।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার দুটি ছেলে মারা গেছে। সেই জন্যই যে আমি এটা করছি, তা ঠিক না। আমার ছেলে মারা গেছে যুদ্ধে। ওদের মৃত্যুর জন্য আমি কোনো বিচার চাই না। আমি বিচার চাই তাদের জন্য, যাদের ওরা ঘরে থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?’
:পারছি।
:
জানি পারবেন। আপনে জ্ঞানী-গুণী মানুষ। অনেকেই পারে না। বুঝলেন ভাই, অনেকে মানবতার দোহাই দেয়। বলে, বাদ দেন। ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা এত সস্তা? অ্যাঁ, বলেন সস্তা?
আমি কিছু বললাম না। জলিল সাহেব পানের কৌটা বের করে পান সাজাতে বসলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনি কি মনে করেছেন, আমি ছেড়ে দেব? ছাড়ব না। আমার দুই ছেলে ফাইট দিয়েছে। আমিও দেব। মৃত্যু পর্যন্ত ফাইট দেব। দরকার হলে বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের সিগনেচার জোগাড় করব। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল, আর কেউ কোনো শব্দ করল না? আমরা মানুষ না অন্য কিছু, বলেন দেখি?’
আমি সিগনেচার ফাইল উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব গোছানো কাজ-কর্ম। সিগনেচারের পাশে বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা। স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত আত্মীয়-স্বজনের নাম-ঠিকানা।
:
অনেকেই মনে করে, আমার মাথা ঠিক নাই। এক পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম, সম্পাদক সাহেব দেখাই করলেন না। ছোকরা মতো একটা ছেলে বলল, ‘কেন পুরোনো কাসুন্দি ঘাটছেন? বাদ দেন, ভাই।আমি তার দাদার বয়সী লোক, আর আমাকে বলে ভাই
:
আপনি কী বললেন?
:
আমি বললাম, তুমি চাও না এদের বিচার হোক? ছেলেটি কিছু বলে না। সরাসরি না বলারও সাহস নাই। অথচ এই ছেলেরা কত সাহসে সাথে যুদ্ধ করেছে। করে নাই?
:
জি, করেছে।
:
আপনার বাড়িওয়ালার কথাই ধরেন। তার এক শালাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ এই লোক সিগচেনার করেনি। ত্রিশ লক্ষ লোক মরে গেল। কোনো বিচার হলো না। মনে হলেই বুকের মধ্যে চিনচিন করে ব্যথা হয়। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভদ্রলোক দ্বিতীয় একটি পান মুখে পুরে বললেন, ‘সরকারি লোকজনদের সাথে দেখা করেছি। তারা আমি কী বলতে চাই, সেটাই ভালো করে শুনতে চায় না। একজন আমাকে বলে, আপনি একটা পরিত্যক্ত বাড়ির জন্য দরখাস্ত করেন। আপনার দুটি ছেলে মারা গেছে। বাড়ি পাওয়ার হক আছে আপনার।
:
আপনি কী বললেন?
:
আমি আবার কী বলব? বাড়ির জন্য পিটিশন করেছি নাকি? বাড়ি দিয়ে আমি করবটা কী? আমার দুই ছেলের জীবন কি সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কত বড় স্পর্ধা, চিন্তা করেন। আমি চাইএকটা বিচার হবে। একটা বিচার চাই। আর কিছুই না। সভ্য সমাজের নিয়মমতো বিচার হবে। বুঝলেন?
:
জি, বুঝলাম।
:
আপনারা জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আপনাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। অন্যরা কেউ বুঝতে চায় না। একেকটা সিগনেচারের জন্য তিনবার করে যেতে হয়। তাতে অসুবিধা নাই। আমি ছাড়বার লোক না।
আমার সিগনেচার নিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর অনেক দিন তাঁর সাথে দেখা হলো না। একটা কৌতূহল জেগে রইল। রাস্তাঘাটে দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছি, কী ভাই, কত দূর কী করলেন?
:
চালিয়ে যাচ্ছি, প্রফেসার সাহেব। দোয়া রাখবেন।
:
লোকজন দস্তখত দিচ্ছে তো?
:
সবাই দেয় না। ভয় পায়।
:
কিসের ভয়?
Thumbs up
:ভয়ের কি কোনো মা-বাপ আছে? ভয় পাওয়া যাদের স্বভাব, তারা ভয় পাবেই। বুঝলেন না, আমি আছি লেগে। আদালতে হাজির করে ছাড়ব। কী বলেন, প্রফেসর সাব?
:
তা তো ঠিকই।
:
ডিস্টিক্টে ভাগ করে ফেলছি। এখন সব ডিস্টিক্টে যাব। কষ্ট হবে, উপায় তো নাই। আপনি কী বলেন?
:
ভালোই তো।
তা ছাড়া শুধু দস্তখত জোগাড় করলেও হবে না। কেইস চালানোর মতো এভিডেন্স থাকতে হবে। বিনা কারণে নিরাপরাধ লোকজন ধরে ধরে মেরেছে, এটা প্রমাণ করতে হবে না? ওরা ঘাগু ঘাগু সব ল-ইয়ার দেবে। দেবে না?
:
তা তো দেবেই।
:
আপনার জানা মতে কোনো ভালো ল-ইয়ার আছে?
:
আমি খোঁজ করব।
:
তা তো করবেনই। আপনি তো অন্ধ না। অন্যায়টা বুঝতে পারছেন। বেশির ভাগ লোকই পারে না। মূর্খের দেশ।
অনেক দিন আর জলিল সাহেবের দেখা পাই নাই। হয়তো সত্যি সত্যি জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছেন। বগলে ভারী ভারী ফাইল। দস্তখতের সংখ্যা হয়তো বাড়ছে। বারো হাজার থেকে পনের হাজার। পনের থেকে বিশ। এমনকি, সত্যি সত্যি হতে পারে যে চল্লিশ পঞ্চাশ লাখ দস্তখত জোগাড় করে ফেলবেন তিনি। পঞ্চাশ লক্ষ লোকের দাবি অত্যন্ত জোরালো দাবি।
বর্ষার শুরুতে খবর পেলাম, জলিল সাহেব অসুখে পড়েছেন। হাঁপানি, সেই সঙ্গে রিউমেটিক ফিবার। বাড়িঅলা বললেন, ‘পাগলা মানুষ। শরীরের যত্ন তো আর কোনো দিন করে নাই। এ যাত্রা টিকবে না।
:
বলেন কী?
:
হ্যাঁ, গ্রিন ফার্মেসির ডাক্তার সাহেব বললেন। আমি নিজেও গিয়েছিলাম দেখতে।
:
অবস্থা কি বেশি খারাপ?
:
বর্ষাটা টিকে কি না
:
বলেন কী?
:
খুবই খারাপ অবস্থা।
বর্ষাটা অবশ্যি টিকে গেলেন। ফাইলপত্র বগলে দিয়ে ঘুরতে বেরোলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলো দুপুরে। আমি চিনতেই পারি না, এমন অবস্থা। তিনি এগিয়ে এলেন, ‘প্রফেসার সাহেব না?’
:
আরে, কী ব্যাপার ভাই? একি অবস্থা আপনার?
:
বাঁচব না বেশি দিন।
:
না বাঁচলে চলবে? এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন।
:
ওইটার জন্য টিকে আছি।
:
সিগনেচার কত দূর জোগাড় হয়েছে?
:
পনের হাজার। মাসে তিন-চার শয়ের বেশি পারি না। বয়স হয়েছে তো। তবে ছাড়ার লোক না আমি।
:
না, ছাড়বেন কেন?
:
কাঠগড়ায় দাঁড় করাব শালাদের। ইহুদিরা পেরেছে, আমরা পারব না কেন? কী বলেন?
:
তা তো ঠিকই।
:
ত্রিশ লাখ লোক মেরেছে বুঝলেন, একটা-দুইটা না। বাংলাদেশের মানুষ সস্তা না? মজা টের পাইয়ে দেব।
আজিমপুরের ওই পাড়ায় আমি প্রায় দু-বছর কাটালাম। এই দু-বছরে জলিল সাহেবের সঙ্গে মোটামুটি ঘনিষ্টতা হলো। মাঝে-মধ্যে যেতাম তার বাসায়। ভদ্রলোকের নিজের বাসা। দোতলাটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় সংসার চলে। স্ত্রী নেই। বড় ছেলের বউ তাঁর সঙ্গে থাকে। ফুটফুটে দুটি মেয়ে আছে সেই বউটির। যমজ মেয়ে বোধ করি। খুব হাসি-খুশি। ভালোই লাগে ও বাড়িতে গেলে। বউটি খুবই যত্ন করে।
পিটিশন সম্পর্কে বাচ্চা দুটির ধারণাও দেখলাম খুব স্পষ্ট। একটি মেয়ে গম্ভীর গলায় আমাকে বলল, ‘দাদার খাতা লেখা শেষ হলে যারা আমার বাবাকে মেরেছে, তাদের বিচার হবে।এই টুকু মেয়ে এত সব বোঝার কথা নয়। জলিল সাহেব নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ওদের বুঝিয়ে বলেছেন।
ওপাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে যেতাম। এরপর ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে গেল। এক সময় দীর্ঘ দিনের জন্য দেশের বাইরে চলে গেলাম।
যাওয়ার আগে দেখা করতে গিয়েছি। শুনলাম, তিনি ফরিদপুর গিয়েছেন সিগনেচার জোগাড় করতে। কবে ফিরে আসবেন, কেউ বলেতে পারে না। তার ছেলের বউ অনেক দুঃখ করল। দুঃখ করার সঙ্গত কারণ আছে। একমাত্র পুরুষ যদি ঘর-সংসার ছেড়ে দেয়, তাহলে জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে।
বাইরে থাকলে দেশের জন্য অন্য রকম একটা মমতা হয়। সেই কারণেই বোধ হয় জলিল সাহেবের কথা মনে পড়তে লাগল। মনে হতো, ঠিকই তো, ত্রিশ লক্ষ লোক হত্যা করে পার পেয়ে যাওয়া উচিত নয়। জলিল সাহেব যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। এটা মধ্যযুগ না। এ যুগে এত বড় অন্যায় সহ্য করা যায় না।
উইকেন্ডগুলোতে বাঙালিরা এসে জড়ো হতো আমার বাসায়। কিছু আন্ডাগ্র্যাজুয়েট ছেলে, মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির অংকের প্রফেসর আফসার উদ্দিন সাহেব। সবাই একমত, জলিল সাহেবের প্রজেক্টে সাহায্য করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করা হবে। বিদেশি পত্রিকায় জনমতের জন্য লেখালেখি করা হবে। আমেরিকার ফার্গো শহরে আমরা এক সন্ধ্যাবেলায় আব্দুল জলিল সংগ্রাম কমিটিগঠন করে ফেললাম। আমি তার আহ্বায়ক। আফসার উদ্দিন সাহেব সভাপতি। বিদেশে বসে দেশের কথা ভাবতে বড় ভালো লাগে। সব সময় ইচ্ছা করে, একটা কিছু করি।
দেশে ফিরলাম ছয় বছর পর।
ঢাকা শহর অনেকখানি বদলে গেলেও জলিল সাহেবের বাড়ির চেহারা বদলায়নি। সেই ভাঙা পলেস্তাঁরা ওঠা বাড়ি। সেই নারিকেল গাছ। কড়া নাড়তেই চৌদ্দ-পনের বছরের ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।
:
তুমি কি জলিল সাহেবের নাতনি?
:
জি।
:
তিনি বাড়ি আছেন?
:
না, দাদু তো মারা গেছেন দু-বছর আগে।
:
ও। আমি তোমার দাদুর বন্ধু।
:
আসুন, ভেতরে এসে বসুন।
আমি বসলাম কিছুক্ষণ। মেয়েটির মায়ের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। ভদ্রমহিলা বাসায় ছিলেন না। কখন ফিরবেন, তারও ঠিক নেই। উঠে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার দাদু যে মানুষের সিগনেচার জোগাড় করতেন, সেই সব আছে?’
:
জি, আছে। কেন?
:
তোমার দাদু যে কাজটা শুরু করেছিলেন সেটা শেষ করা উচিত, তাই না?
মেয়েটি খুব অবাক হলো। আমি হাসিমুখে বললাম, ‘আমি আবার আসব, কেমন?’
:জি-আচ্ছা।
মেয়েটি গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে নরম গলায় বলে, ‘দাদু বলেছিলেন, একদিন কেউ এই ফাইল নিতে আসবে।
আর যাওয়া হলো না।
উত্সাহ মরে গেল। দেশের এখন নানা রকম সমস্যা। যেখানে-সেখানে বোমা ফোটে। মুখ বন্ধ করে থাকতে হয়। এর মধ্যে পুরানো সমস্যা টেনে আনতে ইচ্ছে করে না।
আমি জলিল সাহেব নই। আমাকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। মিরপুরে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি কেনার জন্য নানা ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়। জলিল সাহেবের মতো বত্রিশ হাজার দরখাস্তের ফাইল নিয়ে রাস্তায় বেরোনোর আমার সময় কোথায়?
জলিল সাহেবের নাতনিটা হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্য। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়সী মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।



Banner