বলাইচাঁদ
মুখোপাধ্যায় (জন্ম: ১৯ জুলাই, ১৮৯৯ - মৃত্যু: ৯
ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৯) একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। তিনি
বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত
ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যের মনিহারীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা
সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। তাদের আদি নিবাস হুগলী জেলার শিয়াখালা। বনফুল সবচেয়ে বেশী
বিখ্যাত তাঁর ছোটগল্পের জন্য। আমরা তাঁর ৫৮৬ টি ছোটগল্প, ৬০ টি উপন্যাস, ৫ টি নাটক, বেশ কিছু একাঙ্কিকা, কয়েক হাজার কবিতা, ১ টি আত্মজীবনীমূলক রচনা
"পশ্চাৎপট" এবং অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধাদি পেয়েছি।
ছোটগল্প
কসাই
একটু চটলেই এই তার বুলি, কখনও স্বগত--কথনও প্রকাশ্যত। ছোট নিষ্ঠুর চোখ দুটো, মুখময় ছোট-বড় কতকগুলো আঁচিল, একটা ছোট আরও আছে ডান দিকের চোয়ালটার নিচে। ভ্রু নেই বললেই হয়। দাড়ি আছে। কটা, কোঁকড়ানো, অবিন্যস্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় একটা ওলের উপর কটা চুল গজিয়েছে কতকগুলো। তাকে কেউ বোঝে না। সেও কাউকে বুঝতে চায় না। তাই উদীয়মান কমিউনিস্ট লেখক কমরেড দুলাল দত্ত যখন গল্প লেখার রসদ সংগ্রহ করবার উদ্দেশ্যে তার বাড়ি গিয়ে জিন্নাহ-গান্ধী সম্পর্কিত আলোচনা করে, মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং পাকিস্তান যে কতদূর ন্যায়সঙ্গত, তা বিচার করে, তার প্রকৃত মনোভাব জানবার চেষ্টা করছিল তখন সে তার হলদে শ্বাদন্ত বার করে হাঁ বাবু, হাঁ বাবু, বলে সায় দিচ্ছিল। কিন্তু মনে মনে সে আওড়াচ্ছিল--'শালা হারামিকা বাচ্চা--'
সে জানে কপালে যে লেবেল সেঁটেই আসুক না কেন ফরসা জামা-কাপড়-পরা বাবুমাত্রেই হারামিকা বাচ্চা। ছেঁড়া ময়লা কাপড়-পরা হারামিকা বাচ্চাও সে অনেক দেখেছে। কিন্তু তারা এমন স্বার্থপর ছদ্মবেশি নয়। 'এই বাবু'রাই 'আসলি হারামজাদা--'
কোট-প্যান্ট-পরা আচকান-চাপকান- চড়ানো, খদ্দরধারী মোল্লা-মৌলভী, ডাক্তার-উকিল, হাকিম-ডেপুটি অনেক দেখেছে রহিম কশাই। তার চক্ষে সব শালাই হারামিকা বাচ্চা। সব শালা...
বিশেষ করে ওই দুলালবাবুর বাপটা। শালা সুদখোর। চতুর্থ পক্ষে বিয়ে করেছে হারামজাদা। তাগদের জন্য কচি পাঁঠার ঝোল খায় রোজ। ছেলেও হয়েছে একটা। নধরকান্তি শিশুটা পাশের গলিতে এসে খেলা করে যখন, রহিম কশাই চেয়ে চেয়ে দেখে মাঝে মাঝে। জোঁকের বাচ্চা। বড় হয়ে রক্ত চুষবে। দুলালবাবু আবার দরদ দেখাতে এসেছেন আমাদের জন্য--উড়ুনি উড়িয়ে পাম্পশু চড়িয়ে..শালা হারামিকা বাচ্চা...।
ঘোলাটে চোখ দুটোতে হিংস্রদীপ্তি ফুটে ওঠে। নড়ে ওঠে কটা কোঁকড়ানো দাড়িগুলো। ভারি ধারালো ছোরাটা চালাতে থাকে সজোরে।।..প্রকাণ্ড খাসির রান টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
পুরোহিত যেমন নির্বিকারচিত্তে ফুল তোলে, লেখক যেমন অসংকোচে শাদা কাগজে কালির আঁচড় টানে, রাঁধুনী অবিচলিত চিত্তে যেমন জীবন্ত কই মাছগুলো ভাজে ফুটন্ত তেলে, রহিমও তেমনি ছাগল কুচো করে অকুণ্ঠিত দক্ষতা সহকারে, একটুও বিচলিত হয় না।
একটা খাসি, একটা পাঁঠা, গোটা-দুই বকরী প্রত্যহ জবাই করে সে। আধসের পাঁঠার মাংস দুলালবাবুর বাপকে দিতে হয়। সুদস্বরূপ। কবে পঁচিশ টাকা ধার নিয়েছিল তা আর শোধই হচ্ছে না। ভিটে-মাটি সব বাঁধা আছে। সুদের সুদ..হিসাবের মার-প্যাঁচে বিভ্রান্ত হয়ে শেষে এই সোজা হিসাবে রাজী হয়েছে সে। রোজ আধসের কচি পাঁঠার মাংস। চতুর্থ পক্ষের অনুরোধে শালা তবু রাজী হয়েছে।
কিন্তু এ-ও আর পেরে উঠছে না রহিম। এই দুর্মূল্যের বাজারে রোজ কচি পাঁঠা জোটানো কি সোজা কথা! এ অঞ্চলের যত কচি পাঁঠা ছিল সব তো ওই শালার পেটে গেল। রোজ কচি পাঁঠা পায় কোথা সে। অথচ শালাকে চটানো মুশকিল। এক নম্বর হারামি, হেলথ অফিসারটা পর্যন্ত ওর হাতে-ধরা...ওর কথায় ওঠে-বসে। একটু ইঙ্গিত পেলেই সর্বনাশ করে দেবে।।..সেদিন সমস্ত রোদে ঘুরে ঘুরে রহিম হতাশ হয়ে পড়ল। একটু ভয়ও হল তার। কচি পাঁঠা কোথাও পাওয়া গেল না। কী হবে কে জানে!
হঠাৎ খুন চড়ে গেল তার। কচি পাঁঠা! চতুর্থপক্ষে বিয়ে করেছে শালা, কচি পাঠার ঝোল খাবে রোজ।
হারামিকা বাচ্চা। চিবুকের করা দাড়িগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল।
তার পরদিন বাবুর বাবুর্চি বললে এসে--'কাল তুই যে মাংস দিয়েছিলি একেবারে ফাস্ট কেলাস। খেয়ে বাবুর দিল তর হয়ে গেছে। চেয়েপুটে খেয়েছে সব...।'
রহিম নীরব।
কেবল দাড়ির গোটা কয়েক চুল নড়ে উঠল। বাবুর্চি বলতে লাগল--'খোকাটাকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাবুর মনে সুখ নেই, তা না হলে তোকে ডেকে বকশিশই দিত হয়তো। পাশের গলিতে খেলছিল--কোথায় যে গেল ছেলেটা। বাবু বলেছে, যে খুঁজে দিতে পারবে তাকে পঁচিশ টাকা বকশিশ দেবে। একটু খোঁজ করিস, বুঝলি...কি রে কথা কইছিস না কেন...রহিম পচ করে একবার থুথু ফেলে নীরবে মাংস কুচোতে লাগল। তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছিল।
একটু চটলেই এই তার বুলি, কখনও স্বগত--কথনও প্রকাশ্যত। ছোট নিষ্ঠুর চোখ দুটো, মুখময় ছোট-বড় কতকগুলো আঁচিল, একটা ছোট আরও আছে ডান দিকের চোয়ালটার নিচে। ভ্রু নেই বললেই হয়। দাড়ি আছে। কটা, কোঁকড়ানো, অবিন্যস্ত। হঠাৎ দেখলে মনে হয় একটা ওলের উপর কটা চুল গজিয়েছে কতকগুলো। তাকে কেউ বোঝে না। সেও কাউকে বুঝতে চায় না। তাই উদীয়মান কমিউনিস্ট লেখক কমরেড দুলাল দত্ত যখন গল্প লেখার রসদ সংগ্রহ করবার উদ্দেশ্যে তার বাড়ি গিয়ে জিন্নাহ-গান্ধী সম্পর্কিত আলোচনা করে, মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং পাকিস্তান যে কতদূর ন্যায়সঙ্গত, তা বিচার করে, তার প্রকৃত মনোভাব জানবার চেষ্টা করছিল তখন সে তার হলদে শ্বাদন্ত বার করে হাঁ বাবু, হাঁ বাবু, বলে সায় দিচ্ছিল। কিন্তু মনে মনে সে আওড়াচ্ছিল--'শালা হারামিকা বাচ্চা--'
সে জানে কপালে যে লেবেল সেঁটেই আসুক না কেন ফরসা জামা-কাপড়-পরা বাবুমাত্রেই হারামিকা বাচ্চা। ছেঁড়া ময়লা কাপড়-পরা হারামিকা বাচ্চাও সে অনেক দেখেছে। কিন্তু তারা এমন স্বার্থপর ছদ্মবেশি নয়। 'এই বাবু'রাই 'আসলি হারামজাদা--'
কোট-প্যান্ট-পরা আচকান-চাপকান- চড়ানো, খদ্দরধারী মোল্লা-মৌলভী, ডাক্তার-উকিল, হাকিম-ডেপুটি অনেক দেখেছে রহিম কশাই। তার চক্ষে সব শালাই হারামিকা বাচ্চা। সব শালা...
বিশেষ করে ওই দুলালবাবুর বাপটা। শালা সুদখোর। চতুর্থ পক্ষে বিয়ে করেছে হারামজাদা। তাগদের জন্য কচি পাঁঠার ঝোল খায় রোজ। ছেলেও হয়েছে একটা। নধরকান্তি শিশুটা পাশের গলিতে এসে খেলা করে যখন, রহিম কশাই চেয়ে চেয়ে দেখে মাঝে মাঝে। জোঁকের বাচ্চা। বড় হয়ে রক্ত চুষবে। দুলালবাবু আবার দরদ দেখাতে এসেছেন আমাদের জন্য--উড়ুনি উড়িয়ে পাম্পশু চড়িয়ে..শালা হারামিকা বাচ্চা...।
ঘোলাটে চোখ দুটোতে হিংস্রদীপ্তি ফুটে ওঠে। নড়ে ওঠে কটা কোঁকড়ানো দাড়িগুলো। ভারি ধারালো ছোরাটা চালাতে থাকে সজোরে।।..প্রকাণ্ড খাসির রান টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
পুরোহিত যেমন নির্বিকারচিত্তে ফুল তোলে, লেখক যেমন অসংকোচে শাদা কাগজে কালির আঁচড় টানে, রাঁধুনী অবিচলিত চিত্তে যেমন জীবন্ত কই মাছগুলো ভাজে ফুটন্ত তেলে, রহিমও তেমনি ছাগল কুচো করে অকুণ্ঠিত দক্ষতা সহকারে, একটুও বিচলিত হয় না।
একটা খাসি, একটা পাঁঠা, গোটা-দুই বকরী প্রত্যহ জবাই করে সে। আধসের পাঁঠার মাংস দুলালবাবুর বাপকে দিতে হয়। সুদস্বরূপ। কবে পঁচিশ টাকা ধার নিয়েছিল তা আর শোধই হচ্ছে না। ভিটে-মাটি সব বাঁধা আছে। সুদের সুদ..হিসাবের মার-প্যাঁচে বিভ্রান্ত হয়ে শেষে এই সোজা হিসাবে রাজী হয়েছে সে। রোজ আধসের কচি পাঁঠার মাংস। চতুর্থ পক্ষের অনুরোধে শালা তবু রাজী হয়েছে।
কিন্তু এ-ও আর পেরে উঠছে না রহিম। এই দুর্মূল্যের বাজারে রোজ কচি পাঁঠা জোটানো কি সোজা কথা! এ অঞ্চলের যত কচি পাঁঠা ছিল সব তো ওই শালার পেটে গেল। রোজ কচি পাঁঠা পায় কোথা সে। অথচ শালাকে চটানো মুশকিল। এক নম্বর হারামি, হেলথ অফিসারটা পর্যন্ত ওর হাতে-ধরা...ওর কথায় ওঠে-বসে। একটু ইঙ্গিত পেলেই সর্বনাশ করে দেবে।।..সেদিন সমস্ত রোদে ঘুরে ঘুরে রহিম হতাশ হয়ে পড়ল। একটু ভয়ও হল তার। কচি পাঁঠা কোথাও পাওয়া গেল না। কী হবে কে জানে!
হঠাৎ খুন চড়ে গেল তার। কচি পাঁঠা! চতুর্থপক্ষে বিয়ে করেছে শালা, কচি পাঠার ঝোল খাবে রোজ।
হারামিকা বাচ্চা। চিবুকের করা দাড়িগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠল।
তার পরদিন বাবুর বাবুর্চি বললে এসে--'কাল তুই যে মাংস দিয়েছিলি একেবারে ফাস্ট কেলাস। খেয়ে বাবুর দিল তর হয়ে গেছে। চেয়েপুটে খেয়েছে সব...।'
রহিম নীরব।
কেবল দাড়ির গোটা কয়েক চুল নড়ে উঠল। বাবুর্চি বলতে লাগল--'খোকাটাকে কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাবুর মনে সুখ নেই, তা না হলে তোকে ডেকে বকশিশই দিত হয়তো। পাশের গলিতে খেলছিল--কোথায় যে গেল ছেলেটা। বাবু বলেছে, যে খুঁজে দিতে পারবে তাকে পঁচিশ টাকা বকশিশ দেবে। একটু খোঁজ করিস, বুঝলি...কি রে কথা কইছিস না কেন...রহিম পচ করে একবার থুথু ফেলে নীরবে মাংস কুচোতে লাগল। তার চোখ দিয়ে আগুনের হল্কা বেরুচ্ছিল।
পারুল প্রসঙ্গ
“ও কি তোমাদের মত উপায় ক’রে খাবে নাকি?”
“উপায় ক’রে না খাক–তা ব’লে মাছ দুধ চুরি ক’রে খাওয়াটা–”
“আমার ভাগের মাছ দুধ আমি ওকে খাওয়াব!”
“সে তো খাওয়াচ্ছই–তাছাড়াও যে চুরি করে। এরকম রোজ রোজ–”
“বাড়িয়ে বলা কেমন তোমার স্বভাব। রোজ রোজ খায়?”
“যাই হোক–আমি বেড়ালকে মাছ দুধ গেলাতে পারব না। পয়সা আমার এত সস্তা নয়।”
এই বলিয়া ক্রুদ্ধ বিনোদ সমীপবর্তিনী মেনি মার্জারীকে লক্ষ্য করিয়া চাটজুতা ছুঁড়িল। মেনি একটি ক্ষুদ্র লম্ফ দিয়া মারটা এড়াইয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী পারুলবালাও চক্ষে আঁচল দিয়া উঠিয়া গেলেন। বিনোদ খানিকক্ষণ গুম্ হইয়া রহিল। কতক্ষণ আর এ-ভাবে থাকিবে? অবশেষে তাহাকেও উঠিতে হইল। সে আসিয়া দেখে পশ্চিম বারান্দায় মাদুর পাতিয়া অভিমানে পারুলবালা ভূমি-শয্যা লইয়াছেন।
বিনোদ জিনিসটা লঘু করিয়া দিবার প্রয়াসে একটু হাসিয়া বলিল–“কি করছ ছেলেমানুষী! আমি কি সত্যি সত্যি তোমার বেড়াল তাড়িয়ে দিচ্ছি!”
পারুল নিরুত্তর।
বিনোদ আবার কহিল–“চল চল–তোমার বেড়ালকে মাছ দুধই খাওয়ান যাক্।”
পারুল–“হ্যাঁ, সে তোমার কাছে মাছ দুধ খাওয়ার জন্যে ব’সে আছে কি না? তাড়াবেই যদি, এই অন্ধকার রাত্রে না তাড়ালে চলছিল না?”
“আচ্ছা, আমি খুঁজে আন্ছি তাকে–কোথায় আর যাবে?” বিনোদ লণ্ঠন হাতে বাহির হইয়া গেল।
এদিক ওদিক রাস্তা ঘাট জামগাছতলা প্রভৃতি চারদিক খুঁজিল, কিন্তু মেনির দেখা পাইল না। নিরাশ হইয়া অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল–পারুল ঠিক তেমনি ভাবেই শুইয়া আছে!–“কই দেখ্তে পেলাম না ত বাইরে। সে আসবে ঠিক। চল, ভাত খাইগে চল।”
“চল, তোমাকে ভাত দিই, আমার আর ক্ষিদে নেই।”
“Hunger strike করবে না কি!”
পারুল আসিয়া রান্নাঘরে যাহা দেখিল–তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই :– কড়ায় একটুও দুধ নাই–ভাজা মাছগুলি অন্তর্হিত–ডালের বাটিটা উল্টান।
এই বিসদৃশ ব্যাপার দেখিয়া পারুল অপ্রস্তুত!
বিনোদ এ-সম্বন্ধে আর আলোচনা করা নিরাপদ নয় ভাবিয়া যাহা পাইল খাইতে বসিয়া গেল।
পারুলবালাও খাইলেন।
উভয়ে শুইতে গিয়া দেখে মেনি কুণ্ডলী পাকাইয়া আরাম করিয়া তাহাদের বিছানায়।
“উপায় ক’রে না খাক–তা ব’লে মাছ দুধ চুরি ক’রে খাওয়াটা–”
“আমার ভাগের মাছ দুধ আমি ওকে খাওয়াব!”
“সে তো খাওয়াচ্ছই–তাছাড়াও যে চুরি করে। এরকম রোজ রোজ–”
“বাড়িয়ে বলা কেমন তোমার স্বভাব। রোজ রোজ খায়?”
“যাই হোক–আমি বেড়ালকে মাছ দুধ গেলাতে পারব না। পয়সা আমার এত সস্তা নয়।”
এই বলিয়া ক্রুদ্ধ বিনোদ সমীপবর্তিনী মেনি মার্জারীকে লক্ষ্য করিয়া চাটজুতা ছুঁড়িল। মেনি একটি ক্ষুদ্র লম্ফ দিয়া মারটা এড়াইয়া বাহিরে চলিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী পারুলবালাও চক্ষে আঁচল দিয়া উঠিয়া গেলেন। বিনোদ খানিকক্ষণ গুম্ হইয়া রহিল। কতক্ষণ আর এ-ভাবে থাকিবে? অবশেষে তাহাকেও উঠিতে হইল। সে আসিয়া দেখে পশ্চিম বারান্দায় মাদুর পাতিয়া অভিমানে পারুলবালা ভূমি-শয্যা লইয়াছেন।
বিনোদ জিনিসটা লঘু করিয়া দিবার প্রয়াসে একটু হাসিয়া বলিল–“কি করছ ছেলেমানুষী! আমি কি সত্যি সত্যি তোমার বেড়াল তাড়িয়ে দিচ্ছি!”
পারুল নিরুত্তর।
বিনোদ আবার কহিল–“চল চল–তোমার বেড়ালকে মাছ দুধই খাওয়ান যাক্।”
পারুল–“হ্যাঁ, সে তোমার কাছে মাছ দুধ খাওয়ার জন্যে ব’সে আছে কি না? তাড়াবেই যদি, এই অন্ধকার রাত্রে না তাড়ালে চলছিল না?”
“আচ্ছা, আমি খুঁজে আন্ছি তাকে–কোথায় আর যাবে?” বিনোদ লণ্ঠন হাতে বাহির হইয়া গেল।
এদিক ওদিক রাস্তা ঘাট জামগাছতলা প্রভৃতি চারদিক খুঁজিল, কিন্তু মেনির দেখা পাইল না। নিরাশ হইয়া অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল–পারুল ঠিক তেমনি ভাবেই শুইয়া আছে!–“কই দেখ্তে পেলাম না ত বাইরে। সে আসবে ঠিক। চল, ভাত খাইগে চল।”
“চল, তোমাকে ভাত দিই, আমার আর ক্ষিদে নেই।”
“Hunger strike করবে না কি!”
পারুল আসিয়া রান্নাঘরে যাহা দেখিল–তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই :– কড়ায় একটুও দুধ নাই–ভাজা মাছগুলি অন্তর্হিত–ডালের বাটিটা উল্টান।
এই বিসদৃশ ব্যাপার দেখিয়া পারুল অপ্রস্তুত!
বিনোদ এ-সম্বন্ধে আর আলোচনা করা নিরাপদ নয় ভাবিয়া যাহা পাইল খাইতে বসিয়া গেল।
পারুলবালাও খাইলেন।
উভয়ে শুইতে গিয়া দেখে মেনি কুণ্ডলী পাকাইয়া আরাম করিয়া তাহাদের বিছানায়।
এক ফোঁটা জল
রামগঞ্জের জমিদার
শ্যামবাবু যে খেয়ালী লোক তা জানতাম।
কিন্তু তাঁর খেয়াল যে এতদূর খাপছাড়া হতে পারে তা ভাবিনি। সেদিন সকালে উঠেই এক নিমন্ত্রণ
পত্র পেলাম। শ্যামবাবু তাঁর মাতৃশ্রাদ্ধে সবান্ধবে নিমন্ত্রণ করেছেন। চিঠি পেয়ে আমার মনে কেমন যেন একটু খটকা লাগল। ভাবলাম–শ্যামবাবুর মায়ের অসুখ হল অথচ আমি একটা খবর পেলাম না! আমি হলাম এদিককার ডাক্তার।
যাই হোক নেমন্ত্রন্ন যখন করেছেন তখন যেতেই হবে। গেলাম। গিয়ে দেখি শ্যামবাবু গলায় কাচা নিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করছেন। তাঁর মুখে একটা গভীর শোকের ছায়া। আমাকে দেখেই বল্লেন, “আসুন ডাক্তারবাবু–আসতে আজ্ঞা হোক্!”
দু’চার কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম–“ও, আপনি শোনেননি বুঝি! আমার মা ত আমার ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন–তাঁকে আমার মনেও নেই–ইনি আমার আর এক মা–সত্যিকারের মা ছিলেন।”
ভদ্রলোকের গলা কাঁপতে লাগল।
আমি বললাম–“কি রকম? কে তিনি?”
তিনি বললেন–“আমার মঙ্গলা গাই–আমার মা কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন মনে নেই–সেই থেকে ওই গাইটিই তো দুধ খাইয়ে আমাকে এত বড় করেছে। ওরি দুধে আমার দেহ মন পুষ্ট। আমার সেই মা আমায় এতদিন পরে ছেলে গেলেন ডাক্তারবাবু!”
এই বলে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেল্লেন।
আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না।
যাই হোক নেমন্ত্রন্ন যখন করেছেন তখন যেতেই হবে। গেলাম। গিয়ে দেখি শ্যামবাবু গলায় কাচা নিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা করছেন। তাঁর মুখে একটা গভীর শোকের ছায়া। আমাকে দেখেই বল্লেন, “আসুন ডাক্তারবাবু–আসতে আজ্ঞা হোক্!”
দু’চার কথার পর জিজ্ঞাসা করলাম–“ও, আপনি শোনেননি বুঝি! আমার মা ত আমার ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন–তাঁকে আমার মনেও নেই–ইনি আমার আর এক মা–সত্যিকারের মা ছিলেন।”
ভদ্রলোকের গলা কাঁপতে লাগল।
আমি বললাম–“কি রকম? কে তিনি?”
তিনি বললেন–“আমার মঙ্গলা গাই–আমার মা কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন মনে নেই–সেই থেকে ওই গাইটিই তো দুধ খাইয়ে আমাকে এত বড় করেছে। ওরি দুধে আমার দেহ মন পুষ্ট। আমার সেই মা আমায় এতদিন পরে ছেলে গেলেন ডাক্তারবাবু!”
এই বলে তিনি হু হু করে কেঁদে ফেল্লেন।
আমার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না।
চোখ গেল
সাধারণের চোখে হয়ত সে
সুশ্রী ছিল না।
আমিও তাহাকে যে খুব সুন্দরী মনে করিতাম তাহা নহে–কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতাম। তাহার চোখ দুটিতে যে কি ছিল তাহা জানি না। তেমন স্বপ্নময় সুন্দর চোখ জীবনে কখনও দেখি নাই। দুষ্টু বলিয়াও তাহার অখ্যাতি ছিল।
সেই কুরূপা এবং চঞ্চলা মিনি আমার চিত্ত-হরণ করিয়াছিল! তাহার চোখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম।
মনে আছে তাহাকে একদিন নিভৃতে আদর কইয়া বলিয়াছিলাম–“ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটো কেডে রাখি।”
“কেন?”
“ওই দুটোই ত আমাকে পাগল করেছে। আমি সব চেয়ে ওই দুটোকেই ভালবাসি।”
এত ভালবাসিতাম–কিন্তু তবু তাহাক পাই নাই।
অজ্ঞাত অপরিচিত আর একজন আসিয়া বাজনা বাজাইয়া সমারোহ করিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।
প্রাণে বড্ড বাজিল।
কিন্তু সে বেদনা হয়ত মুছিয়া যাইত যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একটা মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটিত।
মিনি যখন বাপের বাড়ী আসিল, দেখি, তাহার দুটি চক্ষুই অন্ধ। কারণ শোনা গেল যে চোখে গোলাপ জল দিতে গিয়া সে ভুলক্রমে আর একটা ঔষধ দিয়া ফেলিয়াছে।
আমিও তাহাকে যে খুব সুন্দরী মনে করিতাম তাহা নহে–কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতাম। তাহার চোখ দুটিতে যে কি ছিল তাহা জানি না। তেমন স্বপ্নময় সুন্দর চোখ জীবনে কখনও দেখি নাই। দুষ্টু বলিয়াও তাহার অখ্যাতি ছিল।
সেই কুরূপা এবং চঞ্চলা মিনি আমার চিত্ত-হরণ করিয়াছিল! তাহার চোখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম।
মনে আছে তাহাকে একদিন নিভৃতে আদর কইয়া বলিয়াছিলাম–“ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটো কেডে রাখি।”
“কেন?”
“ওই দুটোই ত আমাকে পাগল করেছে। আমি সব চেয়ে ওই দুটোকেই ভালবাসি।”
এত ভালবাসিতাম–কিন্তু তবু তাহাক পাই নাই।
অজ্ঞাত অপরিচিত আর একজন আসিয়া বাজনা বাজাইয়া সমারোহ করিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।
প্রাণে বড্ড বাজিল।
কিন্তু সে বেদনা হয়ত মুছিয়া যাইত যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একটা মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটিত।
মিনি যখন বাপের বাড়ী আসিল, দেখি, তাহার দুটি চক্ষুই অন্ধ। কারণ শোনা গেল যে চোখে গোলাপ জল দিতে গিয়া সে ভুলক্রমে আর একটা ঔষধ দিয়া ফেলিয়াছে।
আমার সঙ্গে আড়ালে একদিন
দেখা হইয়াছিল।
বলিলাম–“অসাবধানতার জন্যে অমন দুটি চোখ গেল!”
সে উত্তর দিল–“কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তাহলে না জানাই ভাল!”
বলিলাম–“অসাবধানতার জন্যে অমন দুটি চোখ গেল!”
সে উত্তর দিল–“কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তাহলে না জানাই ভাল!”
আত্ম-পর
সারা সকালটা খেটেখুটে দুপুর বেলায় দক্ষিণ দিকের বারাণ্ডায় একটা বিছানা
পেতে একটু শুয়েছি। তন্দ্রাটি যেই এসেছে–অমনি
মুখের উপর খপ্ ক’রে কি একটা পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে দেখি একটা কদাকার কুৎসিত পাখীর ছানা। লোম নেই–ডানা নেই–কিম্ভূতকিমাকার! বাগে ও
ঘৃণায় সেটাকে উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে
দিলাম।
কাছেই একটা বেড়াল যেন
অপেক্ষা করছিল–টপ।। করে মুখে করে নিয়ে
গেল। শালিক পাখীদের আর্তরব শোনা যেতে লাগল।
আমি এপাশ ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর চার পাঁচ বছর কেটে গেছে!
আমাদের বাড়ীতে হঠাৎ একদিন আমারই বড় আদরের একমাত্র ছেলে শচীন হঠাৎ সর্পঘাতে মারা গেল। ডাক্তার–কবরেজ–ওঝা–বদ্যি কেউ তাকে বাঁচাতে পারলে না। শচীন জন্মের মত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
বাড়ীতে কান্নার তুমুল হাহাকার।
ভিতরে আমার স্ত্রী মূর্ছিত অজ্ঞান। তাঁকে নিয়ে একজন লোক শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাইরে এসে দেখি দড়ির খাটিয়ার ওপর শুইয়ে বাছাকে নিয়ে যাবার আয়োজন হচ্ছে।
তখন বহুদিন পরে–কেন জানিনা–সেই পাখীর ছানাটার কথা মনে পড়ে গেল।
সেই চার পাঁচ বছর আগে নিস্তব্ধ দুপুরে বেড়ালের মুখে সেই অসহায় পাখীর ছানাটি, আর তার চারদিকে পক্ষীমাতাদের আর্ত হাহাকার।
হঠাৎ যেন একটা অজানা ইঙ্গিতে শিউরে উঠলাম।
আমি এপাশ ওপাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর চার পাঁচ বছর কেটে গেছে!
আমাদের বাড়ীতে হঠাৎ একদিন আমারই বড় আদরের একমাত্র ছেলে শচীন হঠাৎ সর্পঘাতে মারা গেল। ডাক্তার–কবরেজ–ওঝা–বদ্যি কেউ তাকে বাঁচাতে পারলে না। শচীন জন্মের মত আমাদের ছেড়ে চলে গেল।
বাড়ীতে কান্নার তুমুল হাহাকার।
ভিতরে আমার স্ত্রী মূর্ছিত অজ্ঞান। তাঁকে নিয়ে একজন লোক শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাইরে এসে দেখি দড়ির খাটিয়ার ওপর শুইয়ে বাছাকে নিয়ে যাবার আয়োজন হচ্ছে।
তখন বহুদিন পরে–কেন জানিনা–সেই পাখীর ছানাটার কথা মনে পড়ে গেল।
সেই চার পাঁচ বছর আগে নিস্তব্ধ দুপুরে বেড়ালের মুখে সেই অসহায় পাখীর ছানাটি, আর তার চারদিকে পক্ষীমাতাদের আর্ত হাহাকার।
হঠাৎ যেন একটা অজানা ইঙ্গিতে শিউরে উঠলাম।