পরিচিতি: বিংশ শতাব্দীর শুরুতে থেকে আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে নারীমুক্তি
আন্দোলনে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের পর যে মহিয়সীর নাম চলে আসে তিনি হলেন
সুফিয়া কামাল। তাদের একান্ত কর্ম প্রচেষ্ঠার ফলে নারী সমাজ কিছু মানবিক
অধিকার নিয়ে জীবন-যাপন করছে। তাঁদের কাজের ধারাবাহিকতায় নারীমুক্তি
আন্দোলনে বর্তমানে অনেকেই জড়িত। এক্ষেত্রে তাঁদের মতো দক্ষ সংগঠকের অভাব। সেই
অভাব পূরণ করার মাধ্যম হলো এই মহিয়সীদেরকে শুধু স্মরণ নয়, অনুস্মরণ-অনুকরণ করা। তাঁদের রেখে যাওয়া কাজ
সম্পন্ন করার দায়িত্ব নেওয়া। এভাবেই মানুষের শ্রমে মানুষের মুক্তি এসেছে।
গড়ে উঠেছে মানুষের সভ্যতা। মানুষের প্রকৃত মুক্তির আন্দোলনও মানুষকে
করতে হয়। যারা এই আন্দোলনে আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তাদের মধ্যে সুফিয়া
কামাল অন্যতম। তিনি শুধু সমাজ বদলের যোদ্ধাই ছিলেন না, একজন শক্তিমান কবি ও
সাহিত্যিক ছিলেন। জন্মঃ ১৯১১ সালের ২০ জুন, মৃত্যুঃ ১৯৯৯ সালে ২০
নভেম্বর । কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়া (১৯৩৮),মায়া কাজল (১৯৫১),মন ও জীবন (১৯৫৭),শান্তি ও প্রার্থনা
(১৯৫৮),উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪),দিওয়ান (১৯৬৬),মোর জাদুদের সমাধি
পরে (১৯৭২) গল্প কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭) । ভ্রমনকাহিনী সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮),স্মৃতিকথা একাত্তুরের ডায়েরি
(১৯৮৯) ।
ছড়া
ও কবিতা
ছোটন
ঘুমায়
গোল করো না গোল করো না
ছোটন ঘুমায় খাটে।
এই ঘুমকে কিনেত হল
নওয়াব বাড়ির হাটে।
সোনা নয় রুপা নয়
দিলাম মোতির মালা
তাইতো ছোটন ঘুমিয়ে আছে
ঘর করে উজালা।
ছোটন ঘুমায় খাটে।
এই ঘুমকে কিনেত হল
নওয়াব বাড়ির হাটে।
সোনা নয় রুপা নয়
দিলাম মোতির মালা
তাইতো ছোটন ঘুমিয়ে আছে
ঘর করে উজালা।
আজিকার শিশু
আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা
আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন ,পরী, দেও, দানা।
পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে
মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে।
তোমাদের ঘরে আলোর অভাব কভূ নাহি হবে আর
আকাশ-আলোক বাঁধি আনি দূর করিবে অন্ধকার।
শস্য-শ্যামলা এই মাটি মা’র অঙ্গ পুষ্ট করে
আনিবে অটুট স্বাস্থ্য, সবল দেহ-মন ঘরে ঘরে।
তোমাদের গানে, কল-কলতানে উছসি উঠিবে নদী-
সরস করিয়া তৃণ ও তরুরে বহিবে সে নিরবধি
তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর
জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর।
তাহারেই পড়ে মনে
“হে
কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনিসন্ধান।”
কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”
কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতেপারি না কোন মতে।”
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
“দখিন দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”
“এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?”
কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? -শুনি নাই,রাখিনিসন্ধান।”
কহিলাম “ওগো কবি, রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।”
কহিল সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই হ’ল, না হোক এবারে-
আমার গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো, এসেছে তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”
কহিলাম “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”
কহিল সে পরম হেলায়-
“বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল সে কাছে সরি আসি-
“কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতেপারি না কোন মতে।”
জন্মেছি এই দেশে
অনেক কথার গুঞ্জন শুনি
গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।
গানের সুর
সবচেয়ে ভাল লাগে যে আমার
‘মাগো’ ডাক সুমধুর।
আমার দেশের মাঠের মাটিতে
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
কৃষাণ দুপুরবেলা
ক্লান্তি নাশিতে কন্ঠে যে তার
সুর লয়ে করে খেলা।
মুক্ত আকাশে মুক্ত মনের
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
সেই গান চলে ভেসে
জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে
মরি যেন এই দেশে।
এই বাংলার আকাশ-বাতাস
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
এই বাংলার ভাসা
এই বাংলার নদী, গিরি-বনে
বাঁচিয়া মরিতে আশা।
শত সন্তান সাধ করে এর
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।
ধূলি মাখি সারা গায়
বড় গৌরবে মাথা উচু করি
মানুষ হইতে চায়।
সাঁঝের মায়া
অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের
কালে
সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে
দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার_
বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়
দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।
সুমধুর মোহে
ধীরে ধীরে ধীরে
প্রদীপ্ত ভাস্কর এসে বেলাশেষে দিবসের তীরে
ডুবিল যে শান্ত মহিমায়,
তাহারি সে অস্তরাগে বসন্তের সন্ধ্যাকাশ ছায়।
ওগো ক্লান্ত দিবাকর! তব অস্ত-উৎসবের রাগে
হেথা মর্তে বনানীর পল্লবে পল্লবে দোলা লাগে।
শেষ রশ্মিকরে তব বিদায়ের ব্যথিত চুম্বন
পাঠায়েছ। তরুশিরে বিচিত্র বর্ণের আলিম্পন
করিয়াছে উন্মন অধীর
মৌনা, বাক্যহীনা, মূক বক্ষখানি
স্তব্ধ বিটপীর।
তারো চেয়ে বিড়ম্বিতা হেথা এক বন্দিনীর আঁখি
উদাস সন্ধ্যায় আজি অস্তাচল-পথপরি রাখি
ফিরাইয়া আনিতে না পারে
দূর হতে শুধু বারে বারে
একান্ত এ মিনতি জানায় :
কখনও ডাকিয়ো তারে তোমার এ শেষের সভায়!
সাঙ্গ হলে সব কর্ম, কোলাহল হলে অবসান,
দীপ-নাহি-জ্বালা গৃহে এমনি সন্ধ্যায় যেন তোমার আহ্বান
গোধূলি-লিপিতে আসে। নিঃশব্দ নীরব
গানে গানে,
পূরবীর সুরে সুরে, অনুভবি তারে প্রাণে প্রাণে
মুক্তি লবে বন্দী আত্মা-সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে,
নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প
হেমন্ত
সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।
সকাল বেলায় শিশির ভেজা
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।
ঘাসের ওপর চলতে গিয়ে
হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়
শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে।
আরও এল সাথে সাথে
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।
নুতন গাছের খেজুর রসে
লোভ দেখিয়ে মিষ্টি পিঠা
মিষ্টি রোদে খেতে বসে।
হেমন্ত তার শিশির ভেজা
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।
আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়
চুপে চুপে রং মাখাল
আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়।